অমিতাভ সেন, কলকাতা, ৮ অক্টোবর#
ডেকার্স লেনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি ফোন করার একটা দোকান খুঁজতে খুঁজতে। চিত্তদার দোকানসহ সব অফিসপাড়াখ্যাত জলখাবারের দোকান পেরিয়ে, বাঁহাতে দুটো বার-কাম-রেস্তোরাঁ পেরিয়ে বাঁদিকে সরুগলি গিয়ে বড়ো রাস্তায় উঠেছে। তারই মুখে পাওয়া গেল ফোনের দোকানটি। বেশ বড়ো দোকানে ফাঁকা টেবিলে একটা ফোন। দোকানদার তখন জলনেকড়া দিয়ে টেবিল ও ফোন পরিষ্কার করছে। সম্ভবত আমিই প্রথম খদ্দের। পেলাম না, ওপারে ফোন এনগেজড। পরপর দুবার করে পেলাম না। ভীষণ বাথরুম পেয়ে গেছে। উল্টোদিকে খাবার দোকানে যে আটা মাখছিল, তাকে জিজ্ঞেস করায়, ওপাশে সরুগলি দেখিয়ে দিল। গলিটায় ঢুকে দেখি একটা ঘেয়ো কুকুর বসে ঝিমচ্ছে। তারপরে সারিসারি প্লাস্টিকের জার শোয়ানো, তার পাশে বসে হাতে ছোট আয়না নিয়ে একজন ডারই কামাচ্ছেন, তাঁকে প্রশ্ন করায় তিনি ইশারায় আরও ভিতরে যেতে বললেন যেখানে ডেকচিতে রাশিরাশি মুরগীর মাংস ধুচ্ছে একজন, তাকে টপকে ডানদিকে অন্ধকার ঘুপচিতে বাথরুম করতে গিয়ে শুনি ঘটাং ঘটাং আওয়াজ। ওটা একটা প্রেসের পিছনদিকে – সেখান থেকে কাগজ ছাপার শব্দ আসছে। পেচ্ছাপের ঝাঁঝালো গন্ধে দমবন্ধ করে কাজ সেরে প্রায় পালিয়ে এলাম।
এসে আবার ফোন। নেই – সেই এনগেজড টোন, কার সঙ্গে যে জিতেন এতক্ষণ কোথা বলছে? আমার জরুরী ফোন। করতেই হবে উলটো দিকের চায়ের দোকান থেকে দুটাকা দিয়ে হাফ-কাপ চা খেলাম। খেয়ে ফোন করলাম। তখনও কোথা বলছে। তারপর সিগারেটের অর্ধেকটা বার করে ধরিয়ে ফেললাম। সামনের মিষ্টির দোকানে জোর গণ্ডগোল। একজন কর্মচারী বসে বসে কয়লা ভাংছে আর দোকানের মালিক তাকে গাল দিচ্ছে – ‘আমি ছিলাম না বলে যা খুশী করেছিস। ওর ঘাড় ভেঙ্গে মাছ খাস নি।’ কর্মচারী কয়লা ভাঙতে ভাঙতেই বলে – ‘ ও এসে বলুক, আমার সামনে বলুক।’ ‘বলবেই তো। তোরা দোকানে মাছ এনে খাসনি? কাটাপোনা খাচ্ছে। কোন বাড়ির লোক কাটাপোনা খায় হ্যাঁ?’ পাশের উনুনে কচুরি ভাজছিল আরেকজন কর্মচারী। সে থামাতে চেষ্টা করায় গণ্ডগোল আরও বেড়ে গেল। পাশের দোকানের একজন বলল – ‘ খেয়েছে তো কী হয়েছে?’ ব্যস, আগুনে গি, দোকানদার ক্ষেপে গিয়ে বলল ‘ওসব আমার এখানে চলবে না।’ কর্মচারী হাতুড়ি দিয়ে কয়লার স্তূপে প্রচণ্ড এক বাড়ি দিয়ে বলল – ‘থাকবও না, চলে যাব, কাজ দিয়ে মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? আমাকে যেন রোজ মাংস খাওয়াচ্ছে?’
এইবারের চেষ্টায় জিতেনকে পেলাম। দুমিনিট মাত্র কথা বলেছি। তারপর ফিরে দেখি কর্মচারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, চলে যাব, দু হপ্তার মাইনে দিয়ে দাও।’ বলে সে কিন্তু কয়লাভাঙ্গা থামায় নি। দোকানদার দোকানঘর ছেড়ে বাইরের দিকটায় এসে খুঁটিতে হাত রেখে দাঁড়িয়েছে। ওখান থেকে একটু এগোলেই গলির মোড়ের ওইপারে রাজভবনের মাথায় সাদাপাথরের সিঙ্ঘটার মতই দোকানদারের মুখ একটু খোলা – দুটো দাঁত দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আপাতত আক্রমণ প্রত্যাহত।
আক্রমণ দেখলাম আবার খানিক এগিয়ে। টেলিফোনভবন পেরিয়ে যেই ওপারের ফুটে উঠেছি দেখি এক অফিসবাবু একহাতে অফিসের ব্যাগ অন্যহাতে বুকের কাছে একটা গামছা গোট করে ধরা – একটা ১৫/১৬ বছরের হাফপ্যান্ট-শার্টপরা ছেলেকে ধমকাচ্ছেন। আরেকজন পথচারী জিজ্ঞেস করায় বললেন – ‘এমনভাবে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে এমন ধাক্কা মেরেছে আমার বুকে, আমার শরীর খারাপ করছে,’ দেখি ছেলেটা মাথা নিচু করে একটা খালিপা আরেকটা খালিপায়ে ঘষছে। অফিসবাবু অমনি রুখে উঠে ‘দারু পিয়া, দারু নেহি পিয়া’ বলে ছেলেটার হাঁ – না দুরকম ঘাড় নাড়া দেখে, বাঁ হাতে দুই চর। আমি বলেই ফেললাম – ‘কী হচ্ছে দাদা, ছাড়ুন। লোকটাও সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার হাতে গামছা দিয়ে দিল। ছেলেটার কোন তাপ-উত্তাপ নেই। গামছাটা নিয়ে মাথায় বাঁধতে বাঁধতে দৌড় লাগাল। দূরে ওর এক সঙ্গী। দুজনের চেহারা দেখে মুটেমজুর মনে হয়। দুজনে এমন সহজভাবে চলে গেল। ওদের সম্মান আমাদের মধ্যবিত্তদের মতো সহজে ভাঙে না। অফিসবাবুর আক্রমণ ব্যর্থ।
Leave a Reply