নুপুর হালদার, ভাতশালা, ৩০ জুন#
রাত তখন আটটা দশ হবে। ফিরছি সাইকেলে, বেরিয়েছিলাম সেই সকালে পরীক্ষা দিতে। ক্লান্ত শরীর। ভাতশালা গ্রামে ঢোকার গলিপথের ধারে আমারই পাড়ার গুটিকয়েক ছেলে একটি মেয়েকে ঘিরে একটা জটলা করছে। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে কী যেন বলছে, ছেলেগুলো মজা করেই শুনছে। পাশ কাটিয়েই যাচ্ছিলাম চলে। ওদের দু-একটা কথা কানে বাজতেই খটকা লাগল; ঘুরে দাঁড়ালাম। এগিয়ে গিয়ে দেখলাম — একজন বছর সাতাশ আঠাশের তরুণী, দেখতে সুশ্রী সুঠাম, শাড়ি পরিহিতা, চোখে মুখে মফস্বলী ছাপ। জানতে চাইলাম — কী ব্যাপার? এবার মেয়েটি আরো অসহায় ভাবে কাঁদতে কাঁদতে বলল — দেখো, এখন আমি বাড়ি যাই কী করে! আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা কিছু নেই। কী হয়েছে?
— আমি অশোকনগর আট নম্বরে আয়ার কাজ করি। কাজ থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম, এমন সময় একটা ছেলে বাইকে এসে আমায় বলল — সে আমায় ভালোবাসে, আমার সাথে কথা বলতে চায়। বারবার খুব করে আমাকে বাইকে উঠতে বলল, আমাকে এগিয়ে দেবে। আমি প্রথমে আপত্তি করলাম, তবুও পরে ওর জোরাজুরিতে বাইকে উঠলাম। এরপর আমায় এখানে নিয়ে এসে ও আমাকে একটু নামতে বলে। ও বাথরুম করতে যাবে। আমি নামতেই ও হঠাৎ জোরে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে গেল। ওর বাইকেই আমার ব্যাগ টাকা পয়সা মোবাইল সবকিছু ছিল। আমি এখানে কিছু চিনি না। বারাসতের ভেতরের দিকে আমার বাড়ি। বাড়ির সামনে থেকে এমএম ফাইভ বাসে উঠে অশোকনগরে যাতায়াত করে আয়ার কাজ করি। পাশে ছেলেগুলো ঘটনাটার বেশ মজা লুটছে। সাহায্য করার কোনো চেষ্টা নেই তাদের মধ্যে। আমি ওকে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি কুড়িটা টাকা দিয়ে অটোতে হাবড়া গিয়ে ট্রেনে বারাসত যেতে বললাম, রাতে আর ফাঁকা বাসে উঠতে বারণই করলাম। ও তাড়াহুড়ো করে একটা অটো ধরার জন্য এগিয়ে গেল। যেতে যেতে বলে গেল, কখনো দেখা হলে টাকাটা নিয়ে নিও।
বাড়িতে গিয়ে আমি ঘটনাটা সবাইকেই বললাম। বাবা শুনে প্রথমেই বলল, তুই যে মেয়েটাকে টাকা দিলি ছেলেগুলো তোর ওপর যদি রেগে যায়। আমি বুঝে পেলাম না যে ছেলেগুলো এতক্ষণ ধরে মেয়েটিকে কোনোরকম সাহায্য না করে ঘটনার মজা নিচ্ছিল, তারা সাহায্য করতে আসা একটা মানুষের ওপর রেগে যাবে, কেন!
পরদিন সকালবেলা পাশের বাড়ির কাকি এসে বলল, কি রে, কাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করলি? টাকা না দিয়ে দুটো চড় দিতে পারিসনি, এরকম বেবোধ মেয়ে এখনও আছে!
আমাদের সমাজ অন্যায়কারীদের নিয়ে চিন্তিত নয়। অন্যায় যার সঙ্গে ঘটে তাদের নিয়ে চিন্তিত। তারা সতর্ক নয় বলেই এরকম ঘটনার দায় সম্পূর্ণ তাদের। পাশের বাড়ির বৌদি এসেও একইরকম প্রতিক্রিয়া দিয়ে বলল, কাকে তুমি টাকা দিয়ে হেল্প করলে!
Leave a Reply