অসিত রায়, বামনহাট, কোচবিহার, ১৩ এপ্রিল। ২০১১ সালে ফেলানির মৃত্যু নিয়ে সংবাদমন্থনের রিপোর্টের লিঙ্ক এখানে #
মাত্র দু-বছর আগে কাঁটাতারের মাঝে ঝুলন্ত, ১৫ বছরের বাংলাদেশের মেয়ে, ফেলানির মৃতদেহ সারা দুনিয়াকে তোলপাড় করেছিল। ঠিক কি হয়েছিল শীতের সেই রাতে? ফেলানির বাবা নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাগেশ্বরী উপজেলা, কুড়িগ্রাম জেলার একটি গ্রামে থাকতেন। চূড়ান্ত দারিদ্র্যের ফলে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে আসামে গিয়ে বসবাস করতেন। আইনি বা বেআইনি — এ ধরণের দেশান্তর গোটা পৃথিবীতে আকছার ঘটছে। নুরুল ইসলাম তাঁর মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের একটি ছেলের সঙ্গে ৭ জানুয়ারি ২০১১ খুব ভোরে কোচবিহারের দিনহাটা ২ ব্লকের অন্তর্গত চৌধুরিহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে কাঁটাতারের সীমান্ত পেরিয়ে কুড়িগ্রাম পৌঁছবেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে, বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। নুরুল প্রথমে মই বেয়ে পার হলেন। ফেলানি যখন পার হতে গেল, তার পোশাক আটকে গেল কাঁটাতারে। আর্তচিৎকারে ফেলানির গলা ছড়িয়ে পড়ল দিনহাটা-২ ব্লকের আশেপাশে (সীমান্ত ৯৪৭, ৩ এবং ৪ নং পিলারের মাঝখানে)। ‘পানি, পানি’ আওয়াজ শুনে বীরপুঙ্গব বিএসএফ জওয়ানরা নির্বিচারে গুলি করতে শুরু করে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সে জল চেয়েছিল। ফেলানির কান্নায় অনেক মানুষ সেই শীতের ভোরে জড়ো হয়েছিল। তার মধ্যে একজন ছিল এই হাই মাদ্রাসার ক্লাস সিক্সে পড়া ওমর ফারুক। বিএসএফ ফেলানির মৃতদেহ দড়ি দিয়ে বেঁধে বাঁশের খাঁচা বানিয়ে, কাঁধে বয়ে নিয়ে যায় দিনহাটায়। পরদিন ফেলানিকে কবর দেওয়া হয় কুড়িগ্রামে। বিয়ের ছাদনাতলার বদলে কবরে, বাংলাদেশের কাগজে লেখা হল, ফেলানি ঝুলছে না, ঝুলছে বাংলাদেশ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, প্রতি চারদিনে একজন বাংলাদেশিকে এরকম নির্বিচারে হত্যা করে ভারতের সীমান্ত প্রহরীরা। যা বার্লিন প্রাচীরেও ঘটনি।
দিনহাটা আমার জন্মস্থান। কিন্তু সীমান্তে কোনওদিন যাইনি, তাই ফেলানি স্মরণে এবার ঠিক করলাম চৌধুরিহাটের সেই সীমান্তে গিয়ে নিজে উপলদ্ধি ক্রব সীমান্তের মানুষের ইতিবৃত্ত। ফেলানিকে নিয়ে তাদের স্মৃতি কী তা জানব। বুঝব হাজার কিমি জুড়ে কাঁটাতারের এপাশে বা ওপাশে একই ভাষাভাষী মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভাষী সীমান্ত প্রহরীর শাসন ও টহলের মাঝখানে কেমন আছে? ফেলানি ও তার বাবা গিয়েছিল সেই খিতাবের কুঠি গ্রাম পার হয়ে। মাদ্রাসার কিশোর প্রত্যক্ষদর্শী ওমর ফারুককে চিনতে যাব। জানব, কাঁটাতারের ওপারে কোনও নাগরিক পরিষেবা ছাড়াই মানুষ কীভাবে দিন গুজরান করছে? সীমান্ত প্রহরীদের কঠোর বাধানিষেধ কীভাবে তাদের জীবনে প্রতিবন্ধক হয়েছে? পানীয় জল, স্বাস্থ্য শিক্ষা ছাড়া মানুষ সেখানে কি শুধু কাঁটাতার পেরিয়ে একবার ভোট দিতে আসছে? পঞ্চায়েত, বিধানসভা বা লোকসভায়? তাদের জীবনে এইসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কী? কৃষক কীভাবে সেখানে বেঁচে আছে?
তিস্তা-তোর্সায় ২৩ মার্চ নামলাম নিউ কোচবিহার। সেখান থেকে তিন কিমি দূরে মন্থনের বন্ধু রামজীবন ভৌমিকের বাড়ি। গেলাম রিকসায়। একদিন কোচবিহার থেকে দিনহাটা পেরীয়ে সীমান্ত স্টেশন বামনহাটে যাব। কোচবিহারে প্রস্তাব ছিল রাজবাড়ি, সাগরদিঘি, শিবমন্দির, পুণ্ডিবাড়ি, মধুপুরধাম এইসব জায়গা দেখার। রাজমীবনের কাছ থেকে সাইকেল নিয়ে শৈশবের এই ছিমছাম সুন্দর শহরটা ঘুরতে বেরোলাম। দেড় বর্গ কিলোমিটার টলটলে জলের দিঘিটা প্রায় শৈশবের স্মৃতির মতোই আছে। চারপাশে সেই পুরনো সরকারি অফিস, লালরঙা বিল্ডিং, ব্যাঙ্ক, মন্দির স্ট্যাচু ইত্যাদি। রাজাদের সমাধিক্ষেত্র দেখে বিকেলে স্থানীয় কিছু লেখক বুদ্ধিজীবীর সাথে গল্প করে পরদিন ৫০ কিমি দূরের স্টেশন বামনহাট। টিনের বাড়ি আর প্রকৃতি বড়োই মায়াময়। বামনহাট থেকে গিয়ে পৌঁছলাম দিনহাটা ২ ব্লকের চৌধুরিহাট গ্রাম পঞ্চায়েতে রামকৃষ্ণ আশ্রম অতিথি নিবাস। একদম জিরো পয়েন্টে আশ্রমটি। ৪৭ জন ছাত্র থাকে। পড়ে পাশে লাগোয়া হাইস্কুলে। আসামের গোঁসাইগাঁও, ধুবড়ি, শিলিগুড়ি, খড়িবাড়ি, সাউডাঙ্গার যেমন আছে, কোচবিহার, মাদারিহাট ও লোকাল ছেলেও আছে।
লালাগঞ্জ নামে শীর্ণ নদী বয়ে যাচ্ছে বিস্তৃত চায়না ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে। অর্থাৎ বোরো ধান। আশেপাশের গ্রামগুলির পঞ্চায়েত বামফ্রন্টের দখলে। তবে এবার কি হবে বলা যায় না। হিন্দু বেশি সাদিয়ালের কুঠিতে। খিতাবের কুঠি, যেখানে নিহত ফেলানির ফেহ কাঁটাতারে ঝুলছিল তার জনসংখ্যা সব মুসলমান। জায়গীর বেলাবাড়িতে হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই আছে। বিমল মোদক, বয়েস চল্লিশ হল দীর্ঘদেহী, সদাহাস্যময়, পরিশ্রমী, আশ্রম রাঁধুনি। মেয়ে রামু টেনে পড়ে। ছেলে মাধ্যমিক দিয়েছে। স্ত্রী প্রভাতী আশ্রমের রান্নার কাজে সাহায্য করে। চাষ্র জমি আড়াই বিঘে। পুকুর ১ বিঘে। পুকুরে মাছ চাষ করা হয় বৃষ্টি হলে। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র। তার গ্রাম সাদিয়ালের কুঠি বিরাট এলাকা। ২০০০ ঘর। তার মধ্যে ৮০০/৯০০ মুসলমান। ময়মনসিং থেকে আগত মোদকরা বেশি। বর্মনরা কম, তারা রাজবংশী। মসজিদ সাদিয়ালের কুঠিতে নেই। একটা মাদ্রাসা আছে। সেখানেই লোকেরা নামাজ পড়ে। মসজিদ আছে খিতাবের কুঠিতে, জিরো পয়েন্টে। চাষবাস দুটো হয়। আমন ও আউস। বোরো সিজনে পাটও হয়। তবে পাটে বেশি আয় নেই। লেবার পাওয়া যায় না। দিলি, হরিয়ানা, বাঙ্গালোর কেরালায় স্থানীয় মানুষরা লেবারের কাজে ৩০০/৪০০ টাকা মজুরিতে চলে যাচ্ছে। অরুণাচলে ২৫০। এখানে মজুরি ১৫০। বছরে কমদিনই পাওয়া যায়।
আষাঢ় থেকে ভাদ্র আমনধান রোয়া, পাট কেটে পচাতে হয়। বিলে তখন ফাঁকে ফাঁকে বোরো ধান কাটা। বাকি ৭ মাস টুকিটাকি কাজ, বাড়ি মেরামত, জঙ্গল সাফ। ২০০৮ সালে শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর ১০০ দিনের কাজ পেয়েছে মাত্র ৬দিন। পঞ্চায়েতের কাজ প্রায় নেই বললেই চলে। বিমলের ভাষায় যা আছে, ‘তা-ও খেয়ে ফেলায়’। ১৭টা মৌজায় ১৭ জন সদস্য। তার মধ্যে হয়ত ৭/৮ জনের টাকা এসেছে। ৫০ হাজার টাকা করে ভাগ করে নিল, ফলে কিছুই হল না। কোনও সামাজিক সম্পদ তৈরি হল না। এখানে ভেতরে জমির দাম বিঘে প্রতি ২ লাখ টাকা। আমন ধান রোয়া, সার, গাড়া, কাটা, বীজতলা, কীটনাশক সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি খরচ চার হাজার দুশ’ আর ফসল থেকে আয় সাত হাজার। অর্থাৎ দু-হাজার আটশ’ টাকা নিট আয়। বোরো খরচ হিসেব করে দেখা গেল সাত হাজার (২০ মন বিঘে প্রতি), আর আয় আট হাজার পাঁচশ। অর্থাৎ মাত্র দেড় হাজার বিঘা প্রতি নিট আয়। এবার চাষের হিসাবটা দেখা যাক। সার, লেবার, কাটা, ধোয়া মিলিয়ে ছয় হাজার খরচ হলে আয় হচ্ছে আট থেকে দশ হাজার টাকা। তামাকে হাল সার, জৈব সার, লেবার, কাটা, বীজ সব মিলিয়ে খরচ পাঁচ হাজার চারশ আর লাভ মাত্র এক হাজার টাকা। আলুতেও লাভ বেশি নয়। শুধু দেখা যাচ্ছে, ভুট্টাতে এর দ্বিগুন বা তিনগুন লাভ হতে পারে। অর্থাৎ চাষবাসের খরচ দেয়ামের তুলনায় এত বেশি যে চাষিকে হাতে অন্যান্য খ্ররচের টাকা থাকছে না। উপায় শুধু প্রবাসী সন্তানের দিনমজুরি থেকে সঞ্চয়ের টাকা গ্রামে পাওয়া। তাদের টাকা গুরগাঁও ব্যাঙ্গালোর থেকে এলে টিনের গেট বা ছাউনি হয়।
খিতাবের কুঠি গ্রামটি কাঁটাতারের জিরো পয়েন্টে, অর্থাৎ বিএসএফের টহল গ্রামের পাশেই। প্রাইমারি স্কুল কাঁটাতারের পাশে। বিএসএফ ক্যাম্প হাইস্কুলের পাশের। প্রাইমারি স্কুলের সামনে ঈদগা। কাঁটাতারের মাঝে গেটের সংখ্যা তিন। কাঁটাতার দেওয়া হয়েছে সীমান্তের ১৫০ গজ সামনে অর্থাৎ তিন হাজার কিমি-কে ১৫০ গজ দিয়ে গুণ করলে যত জমি হয়, সেখানে চাষ আবাদ কিছুই নেই প্রায়। ১৫ বছর আগে কাঁটাতার দেওয়ার সময় ওপারে যত লোক ছিল তার আশিশতাংশ এদিকে চলে এসেছে। ওপারে বন্দীর মত পড়ে আছে কুড়ি শতাংশ। প্রথমত, যাদের বেশি জমি তাদের বেশির ভাগ চলে এসেছজে কা&টারাতের এদিকে আর দ্বিতীয়ত, যারা অত্যন্ত গরীব তারা রয়ে গেছে বন্দীজীবনে। তিনটে গেট সকালে এক ঘন্টা, সাড়ে বারোটায় এক ঘন্টা আর বিকেলে এক ঘন্টার জন্য খোলে। অঞ্চল প্রধান জোবেদা বিবির বাড়িতে বসে দেখা হল ওপারে থাকা নজরুল ইসলাম নামে এক যুবকের সঙ্গে। সে অভিযোগ নিয়ে এসেছে তার শ্বশুর শ্বাশুটিকে অনেকক্ষণ কাঁতারার পেরোতে দেওয়া হচ্ছে না। ক্যাম্পে গেলেও কম্যান্ডারের সাক্ষাৎ পাঅয়া যাচ্ছে না। তার অতিথিদের সঙ্গে ভোটার কার্ড থাকা সত্ত্বেও ১৮১ ব্যাটেলিটন তাদের পাঁচ ঘন্টা বসিয়ে রেখেছে। হয়রানি করছে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে মত। শেষমেশ জোবেদা বিবির হস্তক্ষেপের ফলে আমার সামনেই পাস পাওয়া গেল। জোবেদা বিবির ছয় ছেলে ছয় মেয়ে। ছেলে এরশাদউল্লার সাথে কথা হল। আগে দিল্লি হরিয়ানাতে অনেক লোক কাজ করতে যেত। এখন ব্যাঙ্গালোর কেরালাতে যাচ্ছে। ওখানে কাজের অভাব নেই। এখানে খিতাবের কুঠিতে সর্মসংস্থান নেই। জমিতে সেচ নেই। ফসল ভালো হয় না। দাম পাওয়া যায় না। মজুরি সামান্য। কোনও শিল্প নেই। এরশাদ জয়পুরে কাজ করত। ১৮০ টাকা মজুরু। ওরসাথে কথা বলার সময় একটি উজ্জ্বল ছেলে সিরাজুলের সঙ্গে দেখা হল। ২০-২১ বছর বয়স। নিরাপত্তার কারণে নাম বদলে লিখলাম। সে তার মোবাইলে ফেলানির কাঁটাতারে ঝুলন্ত মৃতদেহ দেখালো. সংসারে দারুণ অভাব। সাত বছর বয়স থজেকে সে দু-নম্বর ব্যবসা করে, যা কিনা আয়ের একমাত্র উপায় সেখানে। তার পরিবার ল্যান্ড লুজার। ফলে চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবে। দেওয়ানহাট কলেজে দ্বিতীয়ু বর্ষে পড়ে। দিনহাটায় সে পড়ে না, কারণ রাজনীতির মারামারি সেখানে প্রায়ই লেগে আছে। স্থানীয় ভাষায়, ডাঙ্গাডাঙ্গি নিত্যনেমিত্তিক ঘটনা। তাই সে ভালো পড়াশুনোর জন্য দেওয়ানহাটে পরীক্ষা দিয়েছে। রবিবার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা দিল। সে জন পঁচিশ সহকর্মী নিয়ে একমাত্র উপার্জনের রাস্তা জিরে, গোলমরিচ, মশলাপাতি, প্লাস্টিক ব্যাগ বাংলাদেশে পাচার করে, যেখানে চাহিদা ও দাম উভয়ই ভারত থেকে বেশি। এটা অর্থনৈতিক নিয়মে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। গরুপাচার এখন কাঁটাতারের ফলে কমে গেছে। ওখান থেকে আসে কাজ করার মানুষ। কাজ সেরে তারা গিরে যায়। জিনিষপত্র এদিকে আসে না। নির্ভয়ে ও অকপটে সে এসব কথা বলে গেল। এরপর আমার রাঁধুনী বন্ধু বিমলের সঙ্গে সাইকেল করে জায়গীর বেলাবাড়ির জিরো পয়েন্ট আসাম থেকে আগত বিএসএফ কর্মীর সাথে কথা বললাম। ওরা বাংলা বোঝে। কিছু কিছু বলারও চেষ্টা করে।
খিতাবের কুঠির যে অংশে কাঁটাতার, সেখান থেকে লাগোয়া প্রাইমারি স্কুলে প্রতে আসে ক্লাস ফোরে পড়া আশিদা, রুকসানা, রুজিনা, ফরিদা, মনতাজ। ফরিদা ছাড়া আর সবাই আসে এক নং গেট দিয়ে। অসুবিধে ফিরে যাবার সময়। মাস্টারমশাইরা অত্যন্ত সহৃদয়। শনিবার গেটের সামনে অন্তত দু-ঘন্টা বসে থাকতে হয় কখন খুলবে। তিনটেয় স্কুল ছুটি হলে ২-১ ঘন্টা বসে থাকতে হয়। ইলেক্ট্রিক নেই। টিউবওয়েল নিজস্বে বাড়ীতে না থাকলে পানি নেই। চিকিৎসা নেই। চাষের মজুর নেই। তবুও বেশ কিছু ছেলেমেয়ে প্রাইমারি এবং হাইস্কুলে পড়ে। এদের দেখাশুনোর জন্য, সাহায্যের জন্য স্থানীয় সংগঠনের প্রয়োজন অনুভব করলাম।
আশ্রমের ছেলেদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম মুষ্টিভিক্ষার জন্য। বিশাল এক বটগাছের নিচে, কাশীপুরে কয়েকটা ছেলে বসে গল্প করছিল। তাদের বন্ধুদের মধ্যে কাঁটাতারের পূব থেকে আসে ছবি, কামাল, রাহুল, রানু। ওদের ওখানে দোকানপাট নেই। লম্ফের আলোয় পড়ে। গল্প করলাম রেজাউল, লিটন, হারুণ রশিদের সঙ্গে। হাইস্কুলে সিক্স সেভেন এইটে পড়ে। ওদিকে তারা যেতে চায় না কারণ কাঁটাতারের গ্রাম থেকে এখানে তারা খোলা আকাশের নিচে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে। স্থানীয় উৎসব দুর্গামেলা, ফোলের মেলা, খিতাবের কুঠিতে তারাও অংশ নেয়। বামনহাটে বিশহাত কালীমেলা। সেখানে নাগরদোলা, মিষ্টির দীকান, সার্কাস। রাস্তায় রেশন নিয়ে আসছিল বছর পঞ্চাশের অগন্তি মোদক। জমি মাত্র এক বিঘা। কাঁটাতারের ভেতরে সব মুসলমান। যখন এদিকে গরু, ছাগল, উট, খাসি কাটা হয় বড় ঈদে তখন কাঁটাতারের ভেতরে থাকা মানুষের কাছে ঈদ নিরানন্দ। দেখা হল উজ্জ্বল, চিন্তাদীপ্ত ১১/১২ বছরের ওমর ফারুকের সঙ্গে। সুপারি কারখানায় কাজ করত। দশ দিন হল কারখানা বন্ধ। ফারুক সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। সাদিয়ালের কুঠি মাদ্রাসায়। বিজ্ঞান প্রিয় বিষয়। আর সবার সঙ্গে ফেলানির মৃতদেহ সেও দেখতে গিয়েছিল। পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। কারখানায় কাজ করে নিজের বইখাতার খরচ সে নিজেই জোগায়। ১৯ বছরের ইনজামামা নাইনে উঠে ভালো লাগছিল না বলে পড়া ছেড়ে দিল। হরিয়ানায় প্লাইঊড কারখানায় প্রথম কাজ। তারপর বাঙ্গালোর। রোজ আয় ৩৩০ টাকা। এপ্রিল শেষে বামনহাটের কালীর মেলা পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়ে সেখানে আবার কাজে যোগ দেবে। ১৮ বছরের সফিকুল ফেলানির মৃত্য দেখেছে সেদিন টিউশন থেকে ফিরে। খিতাবের কুঠির কাঁটাতারে একজন মেয়ে বিএসএফ-এর গুলি খেয়ে ঝুলে আছে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখতে গিয়েছিল। তার বক্তব্য আড়কাঠিরা টাকা নিয়ে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দিনহাটা থেকে পীস্টম্ররটেম রিপোর্ট থেকে নাকি জানা গেছে, ফেলানিকে হত্যার আগে ধর্ষণও করা হয়েছিল।
সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। এই অঞ্চলে তেমন কোনো উত্তেজনা দেখলাম না। তবে বিমল আমাকে বলল, লোকেরা পরিবর্তন চাইছে। বিশাল কাঁটাতারের এই সীমান্তে এসে মনে হল দিনহাটায় এসে যকহন থাকতাম, তখন বুঝতে পারতাম না, জীবন কত নিষ্ঠুর, কত নিরাপত্তাহীন। অথচ জীবনপ্প্রবাজ এখানে কৎ গতিময়, প্রাণোচ্ছল এবং হয়ত ক্রমাগত অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। মানুষের জীবনধারনের তাগিদেই সীমান্ত পারাপার হতে হয়। ধরা পড়লে কারাবাস বা মৃত্যু। প্রতিটি কাজে তাদের হেনস্থা হতে হয়। কোনও অসুস্থ লোককে চিকিৎসার জন্য এপারে আনতে হলে বেড়ার ফাঁক গলিয়ে আনতে হয়। আন্দোলন সংগঠিত হয়ে কলকাতা বা দিল্লি পর্যন্ত ছড়ালে জুলুম ও অত্যাচার কিছুটা কমতে পারে। পঞ্চায়েতের কাজকর্ম পরিদর্শন করার জন্য শ্ত্রানীয় সংগঠনগুলিকে সক্রিয় হবার কথাও উঠে এল এই স্বল্প থাকার দিনগুলিতে। চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ তোলার আন্দোলন খুব জরুরি। কৃষিপণ্যের বেচাকেনার জন্য খোলামেলা পরিবেশ প্রয়োজন। ফিরে আসার সময় হঠাৎ মনে হল কিছুদিনের জন্য ওপারে কাঁটাতারের বন্দীজীবন কাটালে কেমন হয়?
অথবা, তা যদি না পারি, তাহলে চ্যাংড়াবান্ধা দিয়ে বৈধ সীমান্ত পার হয়ে, পাসপোর্ট হাতে নিয়ে, কুড়িগ্রাম গিয়ে ফেলানির বাবার কাছে সংহতির আশ্বাস দিয়ে আসি। শুধু হাত দুটো জড়িয়ে ধরে কন্যাহার পিতার কাছে নির্বাক সান্ত্বনা দিয়ে বলি, সমস্ত ফেলানির পাশে আছি আমরা।
Leave a Reply