পার্থ কয়াল, ফলতা, ১৫ আগস্ট#
ফলতার কলাতলা হাটে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শুরু হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আগামী দিন কয়েক ধরে চলবে রক্ত পরীক্ষা শিবির, স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির। সেই উপলক্ষে বক্তব্য রাখছেন সাংসদ। বলছেন, ‘আমাদের অনেকেরই ধারণা আছে, শরীরের একফোঁটা রক্ত দিলে শরীর খারাপ হয়ে যায় … মানুষকে সচেতন করে তোলার দায়িত্ব আমাদের।’
কলাতলা হাটে একটি চায়ের দোকানে বসে কয়েকটি স্থানীয় ছেলে — কারখানায় কাজ করে তারা — গল্প করছিল, ‘গেলবার আমাদের পাশের পাড়ার সাথে স্বাধীনতা দিবসে মারপিট হয়েছিল। … আর রোজই রক্ত জল হয়ে যাচ্ছে, আবার …।’ বলতে বলতে উঠে পড়ে। কলাতলা হাট থেকে খান্দালিয়া, সুন্দরিকা ছাড়িয়ে হলদীঘি গ্রাম। লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডলের বাড়ি। একটা পাকা বাড়ির পেছনে মাটির দেওয়াল, বৃষ্টি অল্প অল্প করে হচ্ছে। পাকা বাড়ির পেছনে জল যাতায়াতের জায়গার পাশ কাটিয়ে কিছু জ্বালন জমানো আছে। লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল বসে আছেন পাশের বাড়ির দাওয়ায়। চোখে কালো চশমা। এবাড়ির বড়ো ছেলে গোপাল মণ্ডল মাস কয়েক আগে ফলতায় উঁচু বাড়ির কাজ করতে গিয়ে বাঁশের মাচা থেকে পড়ে মারা যায়। তারপর থেকে ছেলের শোকে চোখের জল ফেলে ফেলে চোখটা অন্ধ করে ফেলেছেন তিনি। তাঁর আরেক ছেলে, সতেরো আঠারো বছর বয়স, এই দিনকতক হল হলদিয়ায় কাজে গেছে। এক হাজার টাকা আগাম দিয়ে দশ কাঠা জমি নিয়েছেন ধান লাগাবেন বলে। কিন্তু বীজতলা করার মতো জমি পাননি। এর ওর কাছ থেকে চেয়েচিন্তে বীজতলা জোগাড় করে তিনটে জন লাগিয়েছেন।
ছেলে কাজ করতে গিয়ে মারা গেছে, টাকা পাননি?
— ‘এখনও পর্যন্ত এক লাখ পঁচাত্তর হাজার টাকা পেয়েছি। ফিক্স করে দিয়েছি। বাকি টাকা এখনও দেয়নি।’ পেছন থেকে ছেলের বাবা বলেন কিছু কথা, অস্পষ্ট স্বরে। মা ঝামটা মারেন, ‘আমি যেটা বলছি সেটাই শোনো। আমাকে যেটা বলেছে, যেটা করেছে, সেটাই বলছি।’ এইসব কথার মাঝেই বাড়ির তুলসিতলায় শাঁখ বাজে, ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে টিমটিম করে। ‘এই আলো দেখছেন, সব হুক করে। আমাদের বিপিএল কার্ডও নেই, কিচ্ছু নেই। আটমাসের কোলের নাতিটা মায়ের সাথে মামাবাড়ি।’
ফিরে আসতে আসতে চোখে পড়ে স্থানীয় চায়ের দোকানে তাসের জটলা। কোনো কোনো বাড়িতে রাতের খাওয়ার তোড়জোড় চলছে। এই গ্রামগুলিতে বেশিরভাগ তফশিলি জাতির বাস। ইট ওঠা কাদা রাস্তায় চলতে চলতে খেয়াল করি, এক জায়গায় মিটার পঁচিশ ঢালাই করা রাস্তা। আস্তে আস্তে ছোটো পিরপানা, সুন্দরিকা, খান্দালিয়া পেরিয়ে কলাতলা হাটের পথে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান চলছে — রঙিলা মারো ঢোল না রে। গান শেষ হলে ঘোষকের ঘোষণা, এবারে স্বপন বসু গাইবেন সেই গান, থাকিলে ডোবাখানা হবে গো কচুরিপানা।
Leave a Reply