যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কলরব আপাতত থেমেছে। যারা রাত জেগে ক্যাম্পাসে থাকছিল, তারা ক্লান্ত, তৃপ্তও বটে। শুধুমাত্র ভিসির পদত্যাগের দাবিতে তো আন্দোলনটা হয়নি, তবু কীভাবে যেন আন্দোলনের মূল দাবি হয়ে উঠেছিল ওটাই। ‘হোককলরব’ মানেই যেন ভিসি-র পদত্যাগ, অভিজিৎ চক্রবর্তীকে গদি থেকে সরাতেই হবে, জেদ চেপে গিয়েছিল। সেই জেদের কিছু ন্যায়সঙ্গত কারণও রয়েছে।
তবে আন্দোলনের ‘সাফল্য’ এবং ‘জয়’-এর মধ্যেই যেগুলো বাকি থেকে গেছে, সেগুলো নিয়েও কথা শুরু হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের ঘোষিত দাবির মধ্যেই ছিল আইসিসি পুনর্গঠন, ছাত্রীর যৌন হেনস্থার সুষ্ঠু তদন্ত, ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশি আক্রমণের যথাযথ তদন্ত, নজরদারি বন্ধ হওয়া। আরও অঘোষিত কত শত সহস্র চাহিদা যে ছাত্রছাত্রীদের আছে, তার পঞ্জি পোস্টার ব্যানার গণভোট আর কতটা দিতে পারে! তাই ‘সাফল্য’র তৃপ্তির মধ্যেই রয়েছে অতৃপ্তিও।
তবে হ্যাঁ, বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ভেতরে অবস্থা যাই হোক, বাইরে মিডিয়াবাহিত হয়ে আসা এই আন্দোলনের ‘জয়’-এর খবর কিছু মানুষের মনে ছাপ ফেলেছে। বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা হচ্ছে। এমনকী ‘বিজয়মিছিল’-এ হাঁটতে হাঁটতেও জনমানুষের প্রচুর প্রশংসা ও শুভেচ্ছা কুড়িয়েছে ছেলেমেয়েরা। কেবল আন্দোলন করে যে দাবি আদায় করা যায়, সেকথা এত নাটকীয়ভাবে ‘প্রমাণ’ হয়নি অনেকদিন। অসংখ্য অন্যায় হয়, তার কিয়দংশের প্রতিবাদও হয়। কিন্তু ন্যায়বিচার যেন প্রায় কখনোই হাসিল হয় না! আন্দোলনের পরিণতির গল্প সবার অগোচরেই থেকে যায় যেন। তাই এই ঘটনাটি বিশেষ, নজরকাড়া। সমাজ কল্যাণের পথে আন্দোলনকে যারা সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় তাদের কাছে ঘটনাটি খুবই সুখপ্রদ।
সরকারের যিনি এক নম্বর, তিনি ছাত্রছাত্রীদের গিয়ে বলে এসেছেন, সরকার সব সময়ই এই আন্দোলনের প্রতি সহমর্মী ছিল। অথচ আন্দোলন চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় গেটে পুলিশ মোতায়েন ও অন্যান্য নজরদারি চেয়ে যখন হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা হয়, সেখানে সরকারপক্ষ পুলিশ মোতায়েন ও নজরদারির পক্ষে সওয়াল করেছিল। বিদায়ী ভিসি তো বলেই দিয়েছেন, সরকারই ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে পুলিশ নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তিনি নন। কই সরকার তো এখনও তার কথার বিরুদ্ধে কোনো বিবৃতি দেয়নি। হাইকোর্টও ২৪ সেপ্টেম্বরের অন্তর্বর্তী রায়ে বলেছিল, রাষ্ট্র সক্রিয় হোক। ওই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে জারি হওয়া নোটিশ কিন্তু এখনও প্রত্যাহৃত হয়নি। সরকারপক্ষ এই রায়ের বিপক্ষে আপিল করেছে বলেও শোনা যায়নি। আশা করা যায় সেগুলো এবার হবে।
শুরু হোক আন্দোলনের নিজেদের মধ্যে সংলাপও। প্রতিরোধের উদযাপন অবশ্যই স্বাগত, কিন্তু ‘সাফল্য’, ‘জয়’ কথাগুলো কি বলা খুব দরকার? যৌন হিংসা যাতে না হয়, তার জন্য রাষ্ট্র, কর্তৃপক্ষের নিশ্চয়ই ভূমিকা থাকে; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারী, এবং সর্বোপরি ছাত্রছাত্রীদেরও অনেক বড়ো ভূমিকা থাকে। আমার পাশের বন্ধুটি যাতে হেনস্থাকারী না হয়ে ওঠে, তার জন্য আমারও কিছু করার থাকে। আমরা সে কাজে ফাঁকি দিচ্ছি না তো? হেনস্থার প্রতিবাদ করছি, হেনস্থাকারীদের নিন্দা করছি, হেনস্থাকারীদের বোঝানোরও চেষ্টা করছি কখনো কখনো। কিন্তু হেনস্থাকারীকে বোঝার চেষ্টা করছি কি? হেনস্থাকারীর পরিবর্তন নিশ্চয়ই প্রয়োজন, কিন্তু আমিও কি অপরিবর্তনীয় থাকতে পারি? পিতৃতন্ত্র নিপাত যাক। কিন্তু পিতৃতন্ত্র কি স্বয়ম্ভু, স্বাধীন? সে নিরন্তর আমাদেরই সমাজের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে কীভাবে? আমরা নিজেদের এত অনিরাপদ মনে করছি কেন?
কলরব তো বারণ হল, এবার কথা হোক কানে কানে।
Leave a Reply