বঙ্কিম, ১৬ ফেব্রুয়ারি#
চালশে চোখে চেয়ে দেখি — লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলে টেবিলে আজকাল কচিকাঁচা প্রাণের চলাচল। পরীক্ষার পড়া ফেলে সহেলি কেবলই গল্প পড়ে বলে মায়ের আক্ষেপ ভেসে আসে কানে। সহেলি পড়ে একাদশ শ্রেণীতে — তাকে কি হতেই হবে ডাক্তার! সে যে বলে, ‘আমার ‘গোরা’ পড়তে ভীষণ ভালো লেগেছে’। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি মুখের দিকে — জীবনানন্দর গল্প মা কিনতে দিল না, বলে আমি নাকি বুঝব না।’ কথায় কথায় ওকে এনবিটি থেকে প্রকাশিত গল্পের বইয়ের কথা বলি — ‘বাংলাদেশের গল্প আমার ভালো লেগেছে’। তারপর মেলার পথনির্দেশিকা খুঁজে স্টল না পাওয়ায় ওকে যাওয়ার নির্দেশ বলে দিয়ে প্রবৃদ্ধ পত্রিকা সম্পাদক বেশ প্রীত হলেন।
ঘন্টাখানেক বাদে দেখি মেলার মাঠে মা ও মেয়ে পাক খেয়েই চলেছে সেই গল্পের বইয়ের খোঁজে। এরপর ওদের সাথে স্টল খুঁজে, গিয়ে দেখলাম সেই বই। ওর পছন্দ বই দুটি — তবুও বেছে নিতে হয়। ও বাংলাদেশের লেখকদের ছোটোগল্পের সংকলনটি নিল। এরপর ণ্ণপ্রতিক্ষণ’-এর স্টলে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ণ্ণচিত্রাবলী’ দেখল অবাক চোখে। ওদিকে সময় নেই। মা দিচ্ছে বাড়ি ফেরার তাড়া। তবুও ও যে দেখে চলেছে — এই সময়েও কত কী! ওরা বিদায় নেয়। … ‘যেতে চাইলেই যাওয়া যায় না, যাওয়াও যেন ফিরে আসা, যেমন করে জোয়ার-ভাঁটায় নদী শেখায় চলার ভাষা।’ স্মৃতি-সত্তা-নাট্য — শ্যামল ঘোষ, পত্রিকা (দাম ৫০০ টাকা)।
অকারণ অস্থির ভিড় ঠেলাঠেলিতে এইখানে এই স্টলে এসে একটা কাঁচের টেবিলের সুদৃশ্য টেবিলের চারধারে চেয়ারে বসতে পেরে একটু সুস্থিরভাবে বই দেখে বেশ তৃপ্তিবোধ হল।
ধাক্কা খেতে খেতে কেবলই সরে যেতে যেতে বইমেলার মাঠে লাট খাই আর দেখি কত কী — একজন বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন একগাদা বই, আর লোককে ডেকে ডেকে বলছেন — ‘কিনতে হবে না, কিনতে হবে না, একটু দেখুন ….’ কারো যেন সময় নেই তাঁকে দেখার, তাঁর কথায় কান দেওয়ার মতো। আমাকে সামনে রেখে বন্ধুটি পাশ কাটিয়েছে, আমি আগ্রহভরে তাঁর কথা শুনি। বড়ো বড়ো প্রকাশক কেন ছাপায় না তাঁর গল্প, তাই তিনি নিজেই নিজের গল্প ছেপে পৌঁছে দিতে চান পাঠকের কাছে। কথার ফাঁকে জানালেন, তিনি চাকরিও করেন। চল্লিশ পাতার গল্প সংকলন, নাম ণ্ণআয়না’, দাম মাত্র ২০ টাকা। লেখিকা পলি বসাক — ফোন নং ৯৪৭৭০৬১২২০।
বইমেলায় যাবার ফুটপাথে রকমারি বইয়ের পসরায় অন্য বইমেলা। দেখি, শুনি, পথচলি। যেতে যেতে বিজ্ঞাপনী কাগজে ভরে ওঠে হাত। যারা হ্যান্ডবিল বিলি করে তারা বেশ দক্ষ — কী দিচ্ছে, কাকে দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে — তা নিয়ে ওরা ভাবে না অতশত। যত বিলি তত পয়সা — বিলি করলেই পয়সা। মানুষজন দেদার একহাতে কাগজ নিচ্ছে অন্যহাতে ফেলতে ফেলতে ছড়াতে ছড়াতে যাচ্ছে। ভূগর্ভপথ ভরে ওঠে গুণমান সমৃদ্ধ সব কাগজে — যত শব — গাছেদের শব — বইমেলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অরণ্য মুহূর্তেই আবর্জনা।
বইমেলার মাঠে সন্তর্পণে পা ফেলি। মেলার মাঠের নির্দেশিকা যত্রতত্র পায়ে লুটায় — কেউ বা
একবার দেখে, কেউবা দেখেও বোঝে না। তবুও কেউ কেউ কাজে লাগায় — পেতে বসে, দামি জামা কাপড় নোংরা হয় না।
বইমেলায় হাঁটাহাঁটি তো করা যায় না। কয়েকটি ছেলের পায়ের কাছ থেকে লিফলেট কুড়িয়ে নিয়ে পড়ি — ওরা ‘অর্ধেক আকাশ’, ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রেমের ইস্তাহার বিলি করে!
একসময় মেলা ছেড়ে বেড়িয়ে আসি। বাঁশের ব্যারিকেডে-মানুষ বাঁধা-পথে। পথের ধারে বাঁশের খুঁটির মাথায় ‘এক সুন্দর পৃথিবীর সন্ধান’ — ছোট একটি নীল রঙের বাংলায়-ইংরাজিতে লেখা পুস্তিকা। যোগাযোগ ashokebanerjee21@gmail.com.
Leave a Reply