অমিতাভ সেন, কলকাতা#
‘বড়ো বড়ো কম্যান্ডো হাঃ হাঃ, বড়ো বড়ো কম্যান্ডো, আমি রাত্তির বেলার কথা বলেছি হাঃ হাঃ’ — পাগল চলেছে বকবক করতে করতে সতীশ মুখার্জি রোড দিয়ে। তার পিছন পিছন রাজমিস্ত্রির জোগাড় হাতে মশলামাখার সিমেন্ট রঙ্গা কড়াই দুলিয়ে ভৌ ভৌ করে কুকুরের ডাক ডাকতে আসছে পাগলকে খ্যাপানোর জন্য। পাগল খেপছে না, বরং দুটো কুকুর ওইদিকে চেয়ে চুপ করে আছে। বেলা বারোটার সূর্য মাথার ওপর, রোদে ভেসে যাচ্ছে গোটা রাস্তা। সকালে গড়িয়া মেট্রো স্টেশনের পাশের রাস্তায় দুটো রোমান্টিক কথা শোনা গিয়েছিল। ইস্কুলের ড্রেসে উঁচু ক্লাসের দুটো ছেলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমজন বক্তা, পিছনের জন শ্রোতা। বক্তা বলছে, ‘আমাকে বলল, আমায় ছেড়ে যাবে না তো, আমি বললাম কখনো ছেড়ে যাব না’। শ্রোতার মুখ হাসিহাসি।
তারপর বাসে উঠেছিলাম। আমার সিটের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সুবেশা তরুণী। কানে হেডফোন গোঁজা, হাতে মোবাইল। উঠেই সে জোর বকা দিল ‘কার ওপরে রাগ? আমার ওপরে? ঠিক করে বলো। না, আমি মোটেই কথাটা ওভাবে বলিনি …’ বাসের গর্জনে আর বাকি কথা শোনা গেল না। মেয়েটা কিন্তু যাদবপুর থেকে উঠে সাউথ সিটি মলে নামা ইস্তক কত কী বলে গেল। মোবাইলে অনেক পয়সা খরচ হচ্ছে বলে ওর মা কি ওকে বকবে? বকলে যে কী গণ্ডগোল হবে, যা কটকটে গলা মেয়েটার!
এখন রাসবিহারীর রাস্তায় প্রাইমারি স্কুল ফেরত বাচ্চাগুলোর নড়া এক হাতে ধরে আরেক হাতে বাচ্চার ব্যাগ ঝুলিয়ে যুবতী মায়েরা যা কলকল করছে ওর অর্ধেকের অর্ধেক করলেও বাচ্চাগুলোকে স্কুলের মিসরা দারুণ শাস্তি দিত। আমি চট করে ভবানীপুরগামী একটা ৩সি/১ বাসে উঠে পড়লাম। এবার আমার পাশে গগলস পরা এক গম্ভীর লোক। হাজরা পেরোনোর সময় তার মোবাইলে রিংটোন, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’। মোবাইল তুলে হ্যালো বলেই তিনি কঠিন গলায় বললেন, ‘না, ওকে দেবে না, কে বলেছে তোমায় ওর নাম লিস্টে রাখতে, না, ওকে দেবে না বললাম তো,
আমি পরে কথা বলছি …’
জগুবাজারে নামতে নামতে ভাবছিলাম, চারপাশে কলকাতায় লোকে বেশ রেগে থাকছে। আর বাড়িও আজকাল খুব ভাঙা পড়ছে — প্রায় নতুন সব বাড়ি। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে একটা দেখে এলাম। আমাদের পাড়ার ২৯ নম্বর বাড়িটা তো একেবারে আস্ত আর পুরো ঝকঝকে — গত দু-হপ্তা ধরে সেটা ভাঙা হল। এত অপচয় চোখে সয় না। সবাই পথ চলতে ঘুরে ঘুরে দেখছিল। আমাকে তো একজন বলল, ‘ওঃ দেখলে হাতুড়ির ঘা মাথায় পড়ছে মনে হচ্ছে’। কিচ্ছু করার নেই, যে শেষ ওই বাড়িটা কিনেছিল সে অনেক বেশি পয়সা পেয়ে এক প্রমোটারকে বেচে দিয়েছে। আর অজুহাত হিসেবে বলে গেছে ও বাড়িতে নাকি ভূতের ভয় আছে। অতি দুঃখে হাসি পেল। ও বাড়িতে আত্মীয়ের কাছে এসে থাকতেন বিখ্যাত অভিনেতা রাধারমণ ভট্টাচার্য। তিনি ‘কাবুলিওয়ালা’ সিনেমায় মিনির বাবার পার্ট করেছিলেন। তাছাড়া ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘ঝিন্দের বন্দি’ সিনেমাতেও অভিনয়ের সুবাদে বড়ো চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নাম করেছিলেন।
দুঃখ কমানোর জন্য অবশ্য জগুবাজারের ফুটপাথে তরকারিওয়ালী মাসি বসেছিল। সে আমায় বলল, ‘বাবা কিছু নেবেনি, অনেকদিন নাওনি।’ গলায় কণ্ঠি পরা এই খনখুনে বুড়ি ক্যানিং লাইন থেকে আসে। হিসেব জানে না বলে খদ্দেরদের বলে তোমরাই হিসেব করে পয়সা দাও। কাউকে ওকে ঠকাতে দেখিনি। আমি তার সামনে উবু হয়ে বেগুন আর শিম বাছতে বসলাম। শুনলাম গান গাইছে গুন গুন করে, ‘নাচো গো রাধারাণী, নাচো গো নিত্যানন্দ …’ একটা পদ বোঝা যাচ্ছে না। ‘বললাম পরের পদটা কী’, মাসি বলল, ‘আঁ, কী বলছ বাবা?’ বললাম, গানের পরের লাইনটা কী? বলল , ‘নাচো গো রাধারাণী দুই বাহু তুলে, নাচো গো নিত্যানন্দ দুই বাহু তুলে …’ বলল মানে সুর করে গাইল। কী যে অপূর্ব সুর, আর কী যে মিষ্টি গলা। মনটা বেশ হাল্কা হয়ে গেল। তাহলে কি ক্যানিং বা কলকাতা থেকে একটু দূরেই চলে যাব — ভাবতে ভাবতে ফিরে এলাম চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী স্ট্রীটে।
Leave a Reply