কুশল বসু, কলকাতা, ৩০ জানুয়ারি#
১৯৮০ সালে মার্কিন-সোভিয়েত ঠান্ডা যুদ্ধের পটভূমিতে ব্রিটেন রাষ্ট্র পরিকল্পনা করে পারমাণবিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত নৌবাহিনীর প্রহরার ব্যবস্থা করবে। প্রাথমিকভাবে দেশে ব্যাপক আপত্তি থাকলেও, সেসবের তোয়াক্কা না করে বৃহত্তর ব্রিটেনের অন্তর্গত স্কটল্যান্ডের ক্লাইডে একটি পারমাণবিক সমরাস্ত্রের গড় তৈরি করা হয় — যার নাম ‘ট্রাইডেন্ট প্রোগ্রাম’। চারটি সাবমেরিনে গোটা পঞ্চাশেক পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বোঝাই করে (যেগুলির মধ্যে বেশ কতগুলি ১০০ কিলোটনের পারমাণবিক রকেট ছুঁড়তে পারে) তৈরি করা হয় একেকটি ‘ফ্লিট’, এবং ১৯৯৪ সাল থেকে অন্তত একটি ফ্লিট সর্বদা ব্রিটিশ উপকূলে ‘রেডি’ থাকার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও ততদিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে, ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হয়েছে, কিন্তু এই ট্রাইডেন্ট প্রোগ্রাম বহাল তবিয়তে থেকে যায়। সরকার পরিবর্তনে এর বিশেষ হেরফের হয়নি। বরং আধুনিকীকরণ হয়েছে, বিশালাকার পারমাণবিক অস্ত্রের বদলে (যেগুলি ব্রিটিশ উপকূল থেকে ছুঁড়লে মস্কো অবধি চলে যেতে পারে) ছোটো ছোটো স্মার্ট পরমাণু রকেট বসানো হয়েছে। কিন্তু সেগুলির একেকটিই বিস্তীর্ণ এলাকা মানুষজন, পশুপাখি, গাছপালা, ভূ-প্রকৃতি ধ্বংস করে দিতে সক্ষম।
এই ট্রাইডেন্ট প্রকল্পের বিরোধিতা কিন্তু থেমে যায়নি। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই ট্রাইডেন্ট প্রকল্পটি যেখানে অবস্থিত, সেই স্কটল্যান্ডের মানুষ, এবং সেখানকার জনপ্রতিনিধিরা তীব্রভাবে এই প্রকল্পের বিরোধিতা করে। আর মূল ব্রিটিশ ভূখণ্ডের জনপ্রতিনিধিরা বরাবর এই প্রকল্পের পক্ষে সংসদে সওয়াল করে এসেছে। এই ট্রাইডেন্ট প্রকল্প ব্রিটিশ সরকারের অন্যতম ব্যয়বহুল সরকারি প্রকল্প।
সম্প্রতি কানাঘুঁষো শোনা যাচ্ছিল, স্কটল্যান্ডের বদলে ওয়েলস-এ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ট্রাইডেন্ট প্রকল্পকে। তার প্রতিক্রিয়ায় ওয়েলস-এর একটি অন্যতম রাজনৈতিক দলের নেতা লর্ড উইগলি টিভি সাক্ষাৎকারে বলে দিয়েছেন, ‘অসউইজের নাজি ক্যাম্পও তো কর্মসংস্থান করেছিল, তাই বলে কি নাজি ক্যাম্পকে সমর্থন করা যায়? আমরা এই সপ্তাহটা পালন করছি ওই ভয়ঙ্কর দিনগুলির স্মরণে। পারমাণবিক অস্ত্রের গড় ট্রাইডেন্ট প্রকল্পও তেমন গণবিধ্বংসী। কর্মসংস্থান করবে এই অজুহাতে একে ওয়েলসে স্থাপন করা সমর্থন করা যায় না।’
ইংল্যান্ডের বিভিন্ন পার্টি জাতীয় পারমাণবিক সমরাস্ত্রের প্রকল্পকে নাজি ক্যাম্পের সঙ্গে তুলনা করে মিডিয়াতে বলা নিয়ে মারাত্মক ক্ষেপে উঠলে উইগলি পরে ক্ষমা চেয়ে নেন, কিন্তু তিনি মূল বক্তব্য থেকে সরে আসেননি। উইগলির বক্তব্য, বিশ্বযুদ্ধের আগের ঘটনাগুলোতে (নাজি আগ্রাসন) ইউরোপে যত লোক মারা গেছে, এই পারমাণবিক অস্ত্র হানলে তার থেকে অনেক বেশি মানুষ মারা যাবে।
এদিকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে সওয়ালকারী কয়েক হাজার মানুষ ২৪ জানুয়ারি লন্ডনে প্রায় ২ মাইল লম্বা একটি মানববন্ধন রচনা করে। তাদের দাবি ছিল, ট্রাইডেন্ট প্রকল্পটিকে সরিয়ে নেওয়ার বদলে একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া দরকার। উল্লেখ্য কয়েকদিন আগে ব্রিটেনের সংসদে ট্রাইডেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হবে কি না তা নিয়ে ভোটাভুটি হয়েছিল। তাতে দেখা যায় বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে পড়েছে মাত্র ৩৭টি ভোট আর তার দশগুণ জনপ্রতিনিধি ভোট দিয়েছেন চালু রাখার পক্ষে। তার চেয়েও আশ্চর্যজনক, এইরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুতে ভোটাভুটির দিন সংসদে ২৫০ জন সদস্য হাজিরই ছিলেন না অথবা ভোট দেননি।
আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, জনপ্রতিনিধিরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। সামনের মে মাসের সাধারণ নির্বাচনে যে সাংসদরা ট্রাইডেন্টের বিপক্ষে অবস্থান না নেবে, তারা হারবে।
Leave a Reply