করোনার বাজারে কাজ হারানো মানুষের কাজের খোঁজে স্কেচ আঁকছেন সুমিত দাস
সুমিত দাস। শান্তিপুর। ১২ অগাস্ট, ২০২০।#
চরকার আওয়াজটা একভাবে কানে আসছে বাড়ির ভেতর থেকে। বাড়ির সামনে গিয়ে নাম ধরে ডাকতেই ভেতর থেকে সাড়া মিললো- কে? দরজা খুলে আমাকে দেখে জেঠিমা বললো, ও সুমিত, এ উদয় সুমিত এয়েচে। বাড়ির ভেতর থেকে চরকার আওয়াজটা থেমে যায়, হ্যাফ প্যান্ট খালি গায়ে বেরিয়ে আসে উদয়দা। উদয়দা আমার কাছে দাদা, বন্ধু, অভিভাবক। একটু বেশিই দাদা, বন্ধু, অভিভাবক। এই মানুষটাকে আমি সব বলতে পারি। ভেবে দেখি সব বিষয়ে এই মানুষটা আমার জীবনে পাশে আছে – প্রেম, বিয়ে, মেয়ের জন্মদিন, মার শরীর খারাপ, বেড়াতে যাওয়া সব কিছুতে। এক কথায় – ডালে-ঝোলে-অম্বলে সব কিছুতে। উদয়দা অনেক কিছু করে, করতে পারে অনেক কিছু। আমি পারিনা। ওর মূলত তাঁত কাপড়ের ব্যবসা। এছাড়া ক্যেটারিং এর কাজ, লস্যি কফি মেশিনের কাজ, বন্ধুর ফার্মের চারাগাছ এখানে সেখানে দিয়ে আসা। কলকাতায় মেসোমশাই এর শাড়ি দিয়ে আসা। উদয়দা মাঝে মাঝেই একটা কথা বলে – ‘যাক গে’। বিশেষ করে যখন আমি কারোর নামে গুছিয়ে নিন্দে করি, হঠাৎ করেই বলে উঠবে- যাক গে। বড় বে-আক্কেলে। আরো কতো সমালোচনা বাকি ছিলো। ও ‘যাক গে’ বলতে পারে। আমি পারিনা। টাইমের ব্যাপারে ওর জুড়ি মেলা ভার। দুপুর বারোটা আর রাত্রি ন’টার পর ওকে আর কেউ আটকে রাখতে পারবে না (যদি না বিশেষ কোনো কাজ থাকে), ও বাড়ির দিকে পা বাড়াবেই। ওদের বাড়িতে অন্য বাড়ির থেকে একটু তাড়াতাড়ি খাওয়া শোওয়া হয়। ও বলে মা জেগে থাকে তাই তাড়াতাড়ি ঢুকি। ও পারে…..
গত শীতে আমাদের সুন্দরবন বেড়াতে যাওয়ার কথা। সব কিছু ঠিক। লঞ্চ ভাড়া হয়ে গেছে। হঠাৎ শুনলাম জেঠিমা মারা গেছেন। আমি তখন কল্যাণীতে। ট্রেনে স্টেশন থেকে ওর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই ফিরতে হয়। খিদে পেয়েছে। শ্মশানে যেতে হবে। মাথা শিখিয়ে দেয় খেয়ে আসাটাই ভালো। আমি পারিনা…. ক্যেটারিং করতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট হয় উদয়দার। ট্রেনে উঠতে গিয়ে খুন্তির হাতলটা ঢুকে যায় কুনুইয়ের কাছে। রক্ত ঝড়তে থাকে। গেঞ্জি খুলে হাতে বাঁধে। গেঞ্জি ভিজে যায়। সবাই বলে ট্রেন থেকে নেমে হাসপাতালে যেতে। নামে না। হাত চেপে বসে থাকে। শান্তিপুরে নামে, হাসপাতালে যায়। ও পারে, আমি পারিনা।
করোনা আসে, কাজ বন্ধ হয়। সব কাজ বন্ধ হয়। আমার ওর সবার কাজ বন্ধ হয়। কাপড়ের ব্যাবসা বন্ধ হয়, ক্যেটারিং বন্ধ হয়, লস্যি কফি বন্ধ হয়। ওরা কয়েকজনে একটা দোকান করে। বেশিরভাগ দ্বায়িত্ব ও নেয়। দোকানে বসে,ঠোঙা বানায় বিক্রি করে। ও পারে আমি পারিনা…..উদয় দা ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। আমি বাংলায় এম.এ.। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে দারুন সিদ্ধান্ত নিতে পারে উদয় দা। অসম্ভব ভালো উপস্থিত বুদ্ধি। আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। ও পারে। আমি পারিনা।
Leave a Reply