কাজ হারানো মানুষের পেশা বদলের স্কেচ আঁকছেন সুমিত
সুমিত দাস। শান্তিপুর। ১৩ জুলাই ২০২০।#
শিয়ালদহ স্টেশনের জনসমুদ্রের মাঝখান থেকে হঠাৎ প্রবর্তক সেনের হাত চেপে ধরেন শঙ্করদা। দাদা আজ কিন্তু লাষ্ট কম্পার্টমেন্টে আমার সাথে উঠতে হবে। নাছোড় শঙ্করের আবদারে প্রবর্তক সেনকে উঠতেই হয় শঙ্করের সাথে। কলকাতায় পাটের কোম্পানিতে কাজ করে শঙ্কর, মাস মাইনে খুব বেশি নয়। বাড়িতে অসুস্থ মা, স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে দিন গুলো মোটামুটি ভাবে কেটে যায়। সদাহাস্যময় শঙ্করদা চেঁচিয়ে ঝালমুড়িওয়ালাকে ডাকলেন। প্রবর্তকদা এই ঝালমুড়িটা একবার খেয়ে দেখুন, জিভের জল ধরে রাখতে পারবেন না। এই এক বাতিক শঙ্করের, কামরায় যা’ই উঠবে ডেকে ঠিক খাওয়াবে। নিজের মুখেই বলে, দিনে আমার হাত খরচা একশো টাকা। ভোর পাঁচটা পঞ্চাশের ট্রেনে কলকাতায় গিয়ে ঐ খাটুনির পর সাতটা পঞ্চাশের ট্রেনে বাড়ী ফেরা। তারপরও কিভাবে একটা মানুষ এতটা হাসি ধরে রাখতে পারে কে জানে- ভাবতে থাকেন প্রবর্তক। এভাবেই পাঁচটা পঞ্চাশ, সাতটা পঞ্চাশের আপ ডাউনে কাটতে থাকে আমাদের দেশের অনেক শঙ্করের জীবন। কিছু দিন ধরে ট্রেন কামরার ইতিউতি করোনা না কি একটা রোগের নাম শঙ্করের কানে আসছিল। তেমন পাত্তা দেয়নি সে। তবে ২১ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর শঙ্কর বুঝতে চেষ্টা করে ব্যাপারটা কী। ২২ মার্চ সারাদেশে জনতা কার্ফু। করোনার চেন ভাঙতে হবে। রাত্রে আলো নেভাতে হবে। থালা বাসন শঙ্খ বাজিয়ে করোনার আপদ বিদেয় করতে হবে। শঙ্কর অবশ্য এসব কিছুই করেনি। ঘরে অসুস্থ মায়ের পাশে বসে শুনেছে পাশের বাড়ির বাবুরা ছাদে উঠে মোমবাতি জ্বালিয়ে গান গাইছেন ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। মার্চ গড়িয়ে এপ্রিল, এপ্রিল গড়িয়ে জুন এসে পড়েছে। বাস, ট্রেন সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। শঙ্কর দা এখন বাড়ী বাড়ী রান্নার মশলা বিক্রি করেন। লকডাউনের বাজারে আমিও বেকার। সকাল বিকাল উদয়দার দোকানে বসে বুড়োদা পলানদার সাথে আড্ডা দিই। শঙ্করদা এসে দাঁড়ায়। খবর নেয় সবার। আমরাও ওর খবর নিই। শঙ্করদা বলতে থাকেন ‘মার শরীর টা খুব খারাপ। লকডাউনে একদিনে সর্বোচ্চ লাভ নব্বই টাকা। কি হয় এ টাকায় বুড়ো বাবু?’ এর মধ্যে সরকারি বাস চললে কলকাতায় গিয়েছিলো শঙ্করদা। কোম্পানি থেকে স্ট্রেট জানিয়ে দিয়েছে এখন আসার দরকার নেই। আর যদি কাজ করতে চান তো কলকাতায় থেকে কাজ করতে হবে। ইউনিয়ন কে জানিয়েও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বুড়োদার কাছে শুনলাম শঙ্করদা মশলার পাশাপাশি লটারি বিক্রির কাজও শুরু করেছে। লকডাউনে একদিনে সর্বোচ্চ ইনকাম ২৯০ টাকা।
শঙ্করদা প্রশ্ন করেন- এভাবে কি কোন মানুষের সংসার চলতে পারে বুড়ো বাবু? পাশ থেকে একজন বলে ওঠে- ‘আজ তো ২৯০ হয়েছে, তুমিও মোমবাতি জ্বালিয়ে ছাদে গিয়ে উই শ্যাল ওভার কাম শুরু করে দাও’।
শঙ্করদা খানিক থমকে যায়। সদাহাস্য মানুষটার মুখ থেকে হাসিটা চলে গিয়ে চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে যায়। শঙ্করদা বলে- ‘আগে তো জানতে হবে কাকে জয় করতে চাইছি?’
Leave a Reply