সকাল সাড়ে সাতটায় এস এন ব্যানার্জী রোডে এসপ্ল্যানেডের দিক থেকে ঢুকলে অবাক লাগে, অমন রাস্তা কী ফাঁকা! ঢিমেতালে দু-একটা বাস-ট্যাক্সি আসছে পুব দিক থেকে। শেষ বৈশাখের তাত জুড়াতে শহরের অর্ধেক রাত পুইয়েছে জেগে জেগে। অফিস পাড়ার ঘুম তাই ভাঙতে চাইছে না। বাঁদিকের ফুট ধরে জানবাজারের দিকে যেতে যেতে দেখি কিছু বাদে বাদেই বেলের পানার দোকান। গরমের সকালে রাস্তার দোকান থেকে বেলের পানা খাচ্ছে মাথায় পাগড়ি বাঁধা স্বাস্থ্য সচেতন সর্দারজী, লুঙ্গি আর ছুঁচলো সাদা দাড়িওয়ালা রসিক চাচা, অভিজ্ঞ হিন্দুস্থানি বুড়হা মাইজী আর রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে তৃষ্ণার্ত ছোকরা ড্রাইভার। এক এক গ্লাস পাঁচটাকা মাত্র। মাঝারি মাপের গ্লাস।
আমি অবশ্য গদ্য জাতীয় কিছু খুঁজছি। তালতলায় টিউশন বাড়িতে ঢোকার আগে পেটে ভারী খাবার ভরে নিতে হবে। তিনদিন আগে এই রাস্তাতেই কচুরি খেয়েছি। সেদিন ডানদিকের ফুটপাথে জানবাজার পেরিয়ে রফি আহমেদ কিদওয়াই স্ট্রিটে পড়ার আগে ডানহাতেই সরুগলির একটু ভিতরে তিনটাকা করে দুটো কচুরী খেয়েছিলাম। গলিটার নাম রায়-হরি-মিস্ত্রি লেন। দোকানটা বেশ পুরোনো। রাস্তা থেকে ফুট চারেক উঁচুতে সিমেন্টের রোয়াকে কালো কাঠের আসবাব আর হলদে বালবের ঘোলাটে আলো তার প্রাচীনতায় মানানসই হয়েছে। কচুরির সাথে জলের মতো পাতলা ঝোল দিয়েছে শালপাতার টুকরিতে। বললাম, তরকারি-টরকারি কিছু নেই কেন? প্রৌঢ় দোকানি হাঁড়ি থেকে হাতায় করে দু’টুকরো আলু দিয়ে বললেন এটা এরকমই। কচুরি খেয়ে জল চেয়ে মুখ ধুতে ধুতে জিজ্ঞেস করলাম, কতদিনের দোকান? বললেন, আমি চালাচ্ছি পঁয়ত্রিশ বছর; যার থেকে দোকান নিয়েছিলাম তিনি ধরুন আরও পনেরো-কুড়ি বছর আগে দোকান খুলেছিলেন। আরও বললেন, তিনি বর্ধমানের লোক, এখানে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন, পরিবার সব দেশে। তারপর উল্টোদিকে গলির মুখের আরেকটা দোকান দেখিয়ে বললেন, ওই দোকানটা দেখছেন, তেলেভাজার দোকান, সাত পুরুষের বেশি ধরে চালাচ্ছে, উড়িয়া বলেই পারছে, বাঙালি হলে পারত না। ওই দোকানটা রানি রাসমণির তৈরি, মন্মথবাবু নিজে দাঁড়িয়ে বানিয়েছেন, ওর ছাদটা দেখুন। দেখলাম দোকানটার মাথার ওপরে চারটে লোহার স্তম্ভ, অন্ধকার লোহার স্তম্ভে কারুকার্যের জায়গায় আরেকটু অন্ধকার, স্তম্ভের মাথায় উল্টোনো পদ্মের আকৃতির গম্বুজের অনেকগুলো পাপড়ি খসে গেছে, গম্বুজের শীর্ষে বল্লমের মতো ধ্বজের দণ্ড কালের নিয়মে পতাকা হারিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে হিসেব করে দেখলাম, দোকানটা তাহলে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বয়সে বড়ো। দোকানটায় তখন দুটো উড়িয়া ছেলে ডালবড়া, বেগুনি ও ফুলুরি ছাড়ছিল গরম তেলের কড়াইয়ে।
আজ সকালে বাঁদিকের ফুটপাথেই কচুরীর দোকান পেয়ে গেলাম জানবাজারের একটু আগেই। রাস্তার ওপর গরম কচুরি ভাজছে। আমি দুটো চাইতে একটু অবাক হল। তারপর হ্যাংলা বাঙালিবাবু দেখে ‘বৈঠিয়ে বৈঠিয়ে’ বলে হিন্দুস্থানি কচুরিওয়ালা আমাকে প্রায় জোর করে ফুটপাথে সারবাঁধা ব্যাটারির একটার ওপর বসিয়ে দিল। তার সাগরেদ এসে আমার হাতে ধরিয়ে দিল একটা শালপাতার ঠোঙায় দুটো গরম কচুরি আর একটা বেশ বড়ো ভাঁড় ভর্তি গরম ঝোল, এতেও আলুর কুচি খুঁজে পেতে ডুবুরি নামাতে হবে। একটা চুমুক দিতেই কিন্তু মনটা তর হয়ে গেল। কী অপূর্ব স্বাদ-গন্ধ। কী যে দিয়েছে — টমেটো, আলু, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা, তেঁতুল গোলা বোঝা যাচ্ছে — আর কী যে আশ্চর্য মশলা দিয়েছে কে জানে! সেই ঝোলের পরিমাণ এতটাই যে আমার চারিদিকে অন্য সহ-খদ্দেররা তাতেই চার-পাঁচখানা করে খেয়ে ফেলছে। আমিও চেয়ে আরেকটা নিতে নিতে জানলাম কচুরি দু টাকা করে। বাঃ, ভালো মজা, এই একই সাইজের কচুরি উল্টোদিকের গলিতে উঁচু দোকানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তিনটাকা করে। তা হোক, ওই গলিতে গিয়েই তো সেই অতি প্রবীণ তেলেভাজার দোকান দেখেছি — যেখান থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেগুনি বা ফুলুরি কিনে খাননি তার গ্যারেন্টি কেউ দিতে পারবে না। আর এই কবিপক্ষে যখন রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষে উপলক্ষ্যে এখনই রানি রাসমণি রোডের মাইক থেকে তাঁরই গান দেবব্রতের কণ্ঠে ভেসে এসে আমাদের কচুরি খাওয়াকে ‘এ শুধু অলস মায়া, এ শুধু মেঘের খেলা’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে তখন তো একটু মান্যি করতেই হবে।
অমিতাভ সেন, কলকাতা, ১৫ মে
Leave a Reply