২২ জুন রবিবার সকাল এগারোটা নাগাদ অসিত নস্কর নামে বছর পঁয়তাল্লিশের এক যুবক সন্তোষপুর স্টেশন সংলগ্ন পাহাড়পুরে কালভার্টের পাশে ম্যানহোলের ভিতর কাজ করতে নেমে তলিয়ে যান। আজ পর্যন্ত তাঁর লাশ উদ্ধার করা যায়নি। ঘটনার দিন দুয়েক আগে পাহাড়পুরে একটা রাস্তা অবরোধ হয়েছিল। কাছেই কালীতলা ও জাহাজিপাড়ায় জল জমা হয়ে বেরোচ্ছিল না। তাই নালা পরিষ্কার করার দাবি ওঠে। স্থানীয় মানুষের কাছে জানা গেছে যে ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলার রঞ্জিৎ মণ্ডলের নির্দেশে (মহেশতলা মিউনিসিপ্যালিটির ১০নং ওয়ার্ড) দুজন নালা পরিষ্কার করার জন্য ম্যানহোলের ভিতর নেমেছিলেন। এঁদেরই একজন ছিলেন অসিত নস্কর। আমরা পত্রিকার পক্ষ থেকে আজ মেটিয়াবুরুজের রামদাসহাটিতে ওঁর বাড়িতে যাই। বাড়িতে ওঁর স্ত্রী শিখা নস্কর ও বড়ো মেয়ে সুমনা পাত্রের সঙ্গে কথা বলি। প্রথমে স্ত্রী বলতে শুরু করেন :#
ঘর থেকে বেরোনোর আগে ছাতু গুলে দিতে বলল, ছাতু গুলে দিলাম। ছাতু খেয়ে দশটা পনেরো নাগাদ বেরিয়েছিল। ১০নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলার রঞ্জিৎ মণ্ডল ডেকেছিল। ওখান থেকে চন্দন বলে একজনের সঙ্গে পাহাড়পুরে কাজে গিয়েছিল। এখানকার একজন সাইকেল নিয়ে পৌঁছে দিয়েছিল। ওখানে গিয়ে ম্যানহোলের ভিতর নেমেছে আমাদের ঘরের লোক, তারপর চন্দন নেমেছে। যে দোকানে টিফিন করেছে, সেখানে লুঙ্গি ছেড়ে গেছে। তারপর …
এরপর বড়ো মেয়ে বলেন :
ভিতরে অ্যামোনিয়ার গন্ধ পেয়ে উঠে এসেছে চন্দনকাকা। উঠে এসে দেখছে বাবা ভিতরটায় নেমে গেছে। ও বাইরে এসে যখন শরীরটা একটু ভালো লাগছে, তখন আবার কোমরে দড়ি বেঁধে নেমেছে। নেমে যখন দেখছে যে বাবা তলিয়ে যাচ্ছে, ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। প্রথমে বাবা যখন নেমেছে, তখন কোনো প্রোটেকশন নেওয়া হয়নি। চন্দনকাকাকে ভর্তি করেছে ওখানকার পাবলিক। কিন্তু তার এখনও পর্যন্ত কোনো খোঁজ নেই। আমরা শুনেছিলাম ক্যালকাটাতে ভর্তি আছে। আমাদের রবীন্দ্রনগরের ওসি বলেছেন, আমি একজন অফিসারকে পাঠাচ্ছি। তারা নাকি হাসপাতালে গিয়ে কথাবার্তা বলেছে। এখন শুনছি সে পুরো নিখোঁজ। কারণ ক্যালকাটা হসপিটালে চোদ্দো দিন রাখবে না। প্রচুর টাকার ব্যাপার।
সেদিন দুপুর দুটো-আড়াইটে নাগাদ ২নং ওয়ার্ডের দুজন লোক আমাদের বাড়িতে আসে। এসে জিজ্ঞেস করল, ণ্ণবাবা বাড়িতে আছে?’ আমি বললাম, ণ্ণবাবা বাড়ি নেই। আমরা এলে বলে দেব।’ আমরা ভাবছি এমনি কোনো লোক, যেমন কেউ খোঁজ নিতে আসে। ওরা বলল, ‘এলে বলে দিস চন্দন ডেকেছে।’ মানে আমাদের ২নং ওয়ার্ডের চন্দন চক্রবর্তী, কাউন্সিলার কাঞ্চন মণ্ডলের অ্যাসিস্ট্যান্ট। তারপর বিকেল চারটের সময় বাবার সঙ্গে কাজ করে দুজন — পবন আর কমল — বাড়িতে আসে। মা তখন সবে ভাত নিয়ে বসেছে খাবে বলে। ওরা জিজ্ঞেস করে, বিলে কখন বার হয়েছে? মা উত্তর দেয়। ওরা বলে, ওখানে একটা বিপদ হয়েছে। দুজন ম্যানহোলে নেমেছিল। একজনকে তোলা হয়েছে, আর একজনকে পাওয়া যাচ্ছে না। যাকে পাওয়া যাচ্ছে না, সে ২নং ওয়ার্ডের। ২নং থেকে তো বাবাই গিয়েছিল। আমরা ভেঙে পড়ি। তারপর খোঁজাখুঁজি করে জানতে পারলাম নালায় তলিয়ে গেছে আমার বাবা।
তারপর থেকে খোঁজাখুঁজি চলছে। চোদ্দো দিন ধরে এই চলছে। ডুবুরি নামানো হয়েছিল। মাঝখানে কিছু লোক গিয়ে একটা ঝামেলা করল। এরপর দু-দিন উদ্ধারের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। গত শনিবার থেকে কোনোরকমে কাজ চলছে। আজকে আবার পাইপ তোলা হবে শুনছি। আমি বার হব বলে রেডি হচ্ছিলাম। আমি রোজ ওখানে যাই। সকাল বিকাল আমি ওখানেই থাকি। সকালে যাই, আবার দুপুরে চলে আসি, আবার বিকেলে যাই।
তিন-চার বছর ধরে বাবা ২নং ওয়ার্ডে হাইড্রেন পরিষ্কারের কাজ করত। নর্মাল কাজ, একশো দিনের কাজ যেমন হয়। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে চার হাজার টাকা মতো মাইনে পেত। বাবা তো সবটা বলত না। এই ওয়ার্ডের ছেলেরা বলছে, আমরা কিছু জানি না। চন্দনকাকা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়িটা শুনেছি ময়লাডিপোর দিকে।
ওই ম্যানহোলের কাজের অভিজ্ঞতা বাবার ছিল না। তাছাড়া সেফটি বেল্ট বা অক্সিজেন, কোনোরকম প্রোটেকশনের ব্যবস্থাও ছিল না। যে রঞ্জিৎ মণ্ডলের কথায় বাবা ওখানে নেমেছিল, তিনি সামনে আসছেন না কেন?
আমরা কাউন্সিলারের কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের ২নং ওয়ার্ড থেকে বলেছিল যে একটা মিসিং ডায়েরি করুন। রবীন্দ্রনগর থানা বলল, এখন ডায়েরি করার দরকার নেই। উদ্ধারের কাজটা এখন হচ্ছে, ওটা হোক। যদি (লাশটা) না পাওয়া যায়, তখন একটা ব্যবস্থা আমরাই করব। সেই কারণে কোনো ডায়েরি করা হয়নি।
আমার বাবা মারাই গেছে। যদি থাকত … আমার বাবা দু-দণ্ড কাজ ছাড়া বাইরে থাকে না। কাজ হয়ে গেলে বাড়িতেই ফিরে আসে। উনি নেই আমরা … মারা তো গেছেই। যদি লাশটা পাওয়া যেত। আমাদের বাঙালি নিয়মে তো কিছু কাজকর্ম করতে হয়। আমাদের পরিবারটা এখন ভাসছে। আমার দুটো বোন আছে। একজন পড়ে, আর একজন ক্লাস টেনে উঠে পড়া ছেড়ে দিয়েছে। আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। মুদিয়ালি জেলেপাড়ায় আমার স্বামীর ঘর ছিল। ২০০১ সালে আমার স্বামী মারা গেছে। আমার একটা ছোটো মেয়ে আছে সাড়ে চার বছরের, বাবাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। এখন বাবা নেই। সমস্ত দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছে।
আমরা মহেশতলা পৌরসভার চেয়ারম্যান দুলাল দাসের কাছে গিয়েছিলাম। আমি, মা, আমার মাসিরা সবাই গিয়েছিলাম। উনি বললেন, আগে আমাকে কনফার্ম হতে দাও, ওকে পাওয়া যাবে কিনা। তারপর আমরা কিছু ব্যবস্থা করব। প্রাপ্য যেটা সেটা তোমরা পাবে।
অসিত নস্করের বহু আত্মীয় পাশাপাশি থাকে। একসময় একান্নবর্তী পরিবার ছিল। এখন সব হাঁড়ি আলাদা। তাঁর ছোটো কাকিমা এসে বলেন, আমরা চাই বউ বা বড়ো মেয়ের একটা কাজের ব্যবস্থা হোক। নাহলে তো সংসারটা ভেসে যাবে।
Leave a Reply