৬ই জুন, কৃষ্ণেন্দু, কোলকাতা ডানলপ#
বিশ্ব-পরিবেশ দিবসে (৫ই জুন) বিকেলে গিয়েছিলাম আনন্দ পাঠশালার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গাছ লাগাতে। বি.টি. রোডের ওপারে রথতলার মোড়ে নেমে বাঁ-হাতে নজরুল মঞ্চ-কে রেখে একটু এগিয়ে ডানদিকে খালপাড় ধরে যে পল্লী সেখানে ওদের ঘর-সংসার। খালপাড় ধরে যেতে চোখে পড়ল বড় বড় গাছের সারি আর তার নিচে ছোট ছোট ঘর। যেন অরন্যের মাঝে কুঁড়ে ঘর। খালের উল্টোদিকে বাঁ-পাশে একটু দূরে এখন বিশাল বিশাল ফ্ল্যাট বাড়ী বার গা থেকে ঝুলছে – সাদা সাদা বাক্স-ঘর ঠাণ্ডা করার যন্ত্র। একসময় ওখানেও ছিল অনেক গাছপালা। রাস্তাটা নাকি চলে গেছে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত।
তখন বিকেল ৩টে হবে। রঞ্জনের সঙ্গে ওখানে পৌঁছতে দেখা হল রাজেশ, মমতা, সুমনা, মিতালি, কামু, বৈশাখী –দের সঙ্গে। একটু পড়ে দেখি ওদের হাতে নিজেদের হাতে আঁকা পোস্টার। বিষয় পরিবেশ। রাজেশ ওর বন্ধুদের নিয়ে পোস্টার টাঙাতে লেগে গেল। কোন পোস্টারে সবুজ গাছ আর তার পাশে মজা-বাঁশ, ওরা জানতে চেয়েছে কবে পরিস্কার হবে এই দুর্গন্ধযুক্ত খাল, কোন পোস্টারের বিষয় একটা গাছ আমাদের যা দিয়ে চলেছে উপকার মূল্যে তা কত! কোন পোস্টারে কারখানার ছবি, বিষয় শিল্প কেবলই দূষণ ছড়ায়। সাইকেল সমাজের বন্ধুদের দেওয়া কিছু পোস্টারের বিষয় “দূষণহীন যান সাইকেল”। পোস্টারগুলোর প্রস্তুতি চলছিল বেশ কয়েকদিন ধরে। পোস্টার গুলো তৈরী করেছে মমতা, রঞ্জন, সুমনা, রাজেশ, প্রিয়াংকারা।
বেলা পড়ে আসছে …. রঞ্জন কিছু বলতে শুরু করল ছোট বন্ধুদের কাছে, ধীরে ধীরে ভিড় জমে গেল ছোট বন্ধু ও তাদের মায়েদের। রঞ্জন বলে চলেছে কোন বাকযন্ত্র ছাড়াই ….. “ ঐ যে ফ্ল্যাট বাড়িগুলো হয়েছে ওগুলো আগে ছিল না, ছিল গাছ, ছিল পাখী, ছিল শেয়াল ….. এইদিকের গাছ গুলোও আর বাকবে না, বড় রাস্তা হবে দক্ষিণেশ্বর পর্যন্ত। গাছ না বাকলে খাব কি? খাবার পাবো কোথায়? এখানে আমরা গাছ লাগাবো, শুধু এখানে নয় এই জায়গার বাইরে গোটা এলাকাতেই যেখানে পারবো গাছ লাগাবো।
বিশ্বের অনেক জায়গায় এক আন্দোলন শুরু হয়েছে, ….. ছোট ছোট স্কুলের ছেলেমেয়েরা যেখানে পারে গাছ লাগায়, রাস্তার ওপরেও গর্ত খুঁজে গাছ লাগায়। শিল্প আমাদের কিছু দেয়না, আর যাই দিক খাবার দেয়না। বিজ্ঞান আমাদের কাছে আজ আর্শীবাদ নয়, অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে। তাই গাছ চাই-ই-চাই, গাছ আমরা লাগাবোই।
আঁধার ঘনিয়ে আসছে রঞ্জনকে থামতে হল। শুরু হল গান, প্রথমে মিলিত কণ্ঠে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গলা মেলালো – বৈশাখী, সুমনা, গোপা তারপর একে একে মোহনা গাইল বালক বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বময়’., গোপা (ওদের গান শেখার দিদি) গাইল “প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরও আরও দাও প্রাণ ….”।
সবশেষে, আসল উৎসব গাছ পোঁতার পালা, এবারে লক্ষীর সঙ্গে যোগ দিল ছোটরা, একে একে ওদের ঘরের পাশে কোথাও পোঁতা হল ণ্ণবাগানবাহার’ তো কোথাও ণ্ণবেল ফুল’ কোথাও জুঁই ফুলের চারা, সবাই মিলে একসাথে গাছে হাত রেখে মাটিতে রোপন হল চারাগাছ। কোন ঘর থেকে বেরোল শাবল, কোন ঘর থেকে ভেসে এল শঙ্খধ্বনি। সন্ধ্যে নেমেছে তখনও ছোট ছোট বাচ্চারা আসছে “আমাকে একটা দাও”। “আমাকে দিলে না”। গাছ পোঁতার পর লজেন্স, আর মিষ্টিমুখের পালা। গোপা নিয়ে এসেছিল লজেন্স, সাইকেল করে গিয়ে হিমাদ্রি নিয়ে এল মিষ্টি। এসেছিল আর মিত্রও।
ফিরে আসছি, পিছনে পড়ে রপিল এক সুন্দর বিকেল। সন্ধ্যে নেমেছে ঐ পাড়াতেই এক তেলেভাজার দোকানে উনুনে আঁচ পড়েছে, চায়ের দোকান গাড়িতে বিক্রি হওয়া ফুচকা, একপাশে ট্যাপ কলের জল, কলতলায় মায়েরা বাসন মাজছেন, সব মিলিয়ে এক সুন্দর ছন্দময় বিকেল।
রাজেশের কথাগুলো মনে পড়ছিল …. কাকু ঐ যে দখছো ফ্ল্যাটবাড়িগুলো, ওখানে অনেক শিয়াল ছিল, ওই যে ঝিলটা ওখানে বর্ষার সময় গঙ্গার ইলিশ ভেসে আসতো …। রঞ্জনকে একটি বাচ্চা মেয়ে বলে “কাকু তোমরা আর পড়াতে আসো না কেন”? “আমাদের তো এখানে পড়ানোর ঘর নেই, পড়াতে বাধা পাই”। “আমাদের নিজস্ব একটা কিছু থাকলে বেশ হতো না। কেউ বাধা দিতে পারতো না।”
ওদের সংশয় আর কতদিন এই সব গাছ, পরিবেশ ওরা রক্ষা করতে পারবে। তার কারণ কামারহাটি পৌরসভার নির্দেশ বাসিন্দাদের সরে যেতে হবে। রাস্তা চওড়া হবে। গাছগুলো হয়তো থাকবে না, কারণ ওরা তো বাসিন্দাদের মতো করে সরে যেতে পারবে না। যদিও কামারহাটি পৌরসভাই ঐ দিনে পরিবেশ দিবস পালন করেছে অন্যত্র গাছ রোপন করে।
Leave a Reply