হার্ভে ওয়াসেরম্যান, www.frepress.org থেকে নেওয়া, মূল লেখাটি ২০ সেপ্টেম্বর লেখা#
আর দু’মাসের মধ্যে আমরা মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম বড়ো সঙ্কটের মুখোমুখি হতে চলেছি। এখনই কাজে নামা ছাড়া আর উপায় নেই। ফুকুশিমার ৪ নং চুল্লির ব্যবহৃত জ্বালানি যেখানে জমা আছে, তার দিকে আমাদের গোটা প্রজাতিকে তার হাতে থাকা সমস্ত সম্পদ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ফুকুশিমার মালিক, টোকিও ইলেকট্রিক কোম্পানি (টেপকো) বলেছে, আর মাত্র ৬০ দিনের মধ্যে সে চেষ্টা করবে ১৩০০টি ব্যবহৃত জ্বালানি রড সরিয়ে ফেলতে, যা এখন খোলা আকাশের নিচে ১০০ ফুট উঁচুতে একটা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কুলুঙ্গীতে রাখা আছে। কুলুঙ্গীটি রয়েছে একটা ক্ষতিগ্রস্ত কাঠামোর ওপর যা বাঁকছে, ডুবছে, এবং যদি নিজে থেকে না ভেঙে পড়ে, তবে পরের ভূমিকম্পে ভেঙে পড়বে নিশ্চিত।
ওই কুলুঙ্গীতে রাখা ৪০০ টনের মতো জ্বালানি থেকে যে পরিমাণ বিকীরণ হতে পারে, তা হিরোসিমা পরমাণু বোমের ১৫ হাজার গুণ।
একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, এই সঙ্কট মোকাবিলার জন্য যে বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত অথবা অর্থনৈতিক সম্পদ দরকার, তা টেপকোর নেই। জাপান সরকারেরও নেই। আসন্ন বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রয়োজন আবিশ্ব সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও কলাকুশলীদের সম্মিলিত প্রয়াস।
কেন এটা এত জরুরি?
আমরা এরমধ্যে জেনে গেছি, হাজার হাজার টন মারাত্মক তেজস্ক্রিয় জল ফুকুশিমা পরমাণু প্রকল্পের থেকে ভূ-গর্ভস্থ জলে মিশছে। বিষাক্ত দীর্ঘজীবী আইসোটপগুলো চলে যাচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরে। ফুকুশিমার তেজস্ক্রিয়তা মাখা সামুদ্রিক উদ্ভিদ পাওয়া গেছে ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে। আমাদের আরও অনেক খারাপ কিছুরই আশঙ্কা করতে পারি।
ফুকুশিমার তিনটি গলে যাওয়া চুল্লি যে কোনও মূল্যে ঠাণ্ডা রাখার জন্য টেপকো সেখানে আরও আরও জল ঢেলে চলেছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে মনে হচ্ছে, ফিশন হয়তো এখনও চলছে মাটির নিচে কোথাও। কিন্তু কেউ জানে না, চুল্লির কোরগুলি ঠিক কোথায় রয়েছে।
এই তেজস্ক্রিয় জলের বেশির ভাগই জমা করা হচ্ছে চুল্লির আশেপাশে তাড়াহুড়ো করে গড়ে তোলা হাজার খানেক নড়বড়ে ট্যাঙ্কে। অনেকগুলোই এরমধ্যেই লিক করতে শুরু করেছে। পরবর্তী ভূমিকম্পে সবগুলো মাটিতে মিশে যাবে, প্রশান্ত মহাসাগরে ছড়িয়ে পড়বে হাজার হাজার টন স্থায়ী বিষ। নিত্যনতুন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, টেপকো সদ্য আরও হাজার টনের মতো তেজস্ক্রিয় তরল সাগরে ফেলেছে।
প্রকল্পে ঢালা জলে ফুকুশিমার যেটুকু কাঠামো এখনও টিঁকে রয়েছে, তা আরও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, ৪ নং ইউনিটের জ্বালানি রডের কুলুঙ্গীটি শুদ্ধু।
৪ নং চুল্লির ৫০ মিটার দূরত্বে সাধারণ কুলুঙ্গীতে ৬০০০ জ্বালানি রড রাখা আছে এখন। তাদের কিছুতে আছে প্লুটোনিয়াম। এই কুলুঙ্গীটির মাথার ওপর কোনও ঢাকনা নেই। ঠাণ্ডা রাখার ব্যবস্থা নষ্ট হলে, পাশের কাঠামোটি ভেঙে পড়লে, আরেকটি ভূমিকম্প হলে বা সুনামি হলে এবং আরও এই ধরনের হাজার কারণে এই কুলুঙ্গীটি ভেঙে পড়তে পারে।
সব মিলিয়ে ১১ হাজারের মতো জ্বালানি দণ্ড ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ফুকুশিমার প্রকল্প এলাকা জুড়ে। মার্কিন পরমাণূ বিভাগের প্রাক্তন অফিসার ও প্রবীণ বিশেষজ্ঞ রবার্ট আলভারেজ-এর মতে চের্নোবিলে যে পরিমাণ প্রাণঘাতি সিজিয়াম ছড়িয়েছিল, তার তুলনায় ৮৫ গুণ রয়েছে এখানে।
সারা জাপান জুড়ে পাওয়া যাচ্ছে তেজস্ক্রিয় হটস্পট। স্থানীয় বাচ্চাদের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত থাইরয়েড দেখা যাচ্ছে।
বোঝাই যাচ্ছে, এক্ষুনি ওই জ্বালানি দণ্ডগুলো ৪ নং ইউনিটের জ্বালানি কুলুঙ্গী থেকে বের করে আনা দরকার।
১১ মার্চ ২০১১-র ভূমিকম্প এবং সুনামিতে ফুকুশিমার বিপর্যয় সংগঠিত হওয়ার ঠিক আগে, ৪ নং ইউনিটের কোর-টি বের করে আনা হয়েছিল নিয়মমাফিক সুরক্ষা এবং জ্বালানি পুনর্সংযোগের জন্য। (ফলে বিপর্যয়ের সময় ওই চুল্লিতে ছিল সদ্য লোড হওয়া টাটকা জ্বালানি, কোরের মধ্যে, এবং ব্যবহৃত জ্বালানি, কোরের খুব কাছেই একটু উঁচুতে রাখা কুলুঙ্গীতে)। আমেরিকা ও বিশ্বের অন্যান্য জায়গার বেশ কিছু চুল্লির মতো জেনারেল ইলেকট্রিকের গড়া এই চুল্লিতেও কোরের কাছেই ১০০ ফুট উঁচুতে থাকে জ্বালানি কুলুঙ্গী।
ব্যবহৃত জ্বালানি যে করে হোক জলের তলায় রাখতেই হয়। এটা জারকোনিয়ামের সঙ্করের আবরণে থাকে যা বাতাসের সংস্পর্শে আসলে নিজে থেকেই জ্বলে ওঠে। জারকোনিয়ামের ব্যবহার অনেকদিন ধরেই ক্যামেরার ফ্ল্যাশবাল্বে করা হয়, এর খুব উজ্জ্বল শিখার কারণে।
প্রতিটি উন্মুক্ত রড থেকে এতটাই বিকিরণ হতে পারে, যা কাছে দাঁড়ানো কোনও মানুষকে কয়েক মিনিটের মধ্যে মেরে ফেলতে পারে। একটা বড়োসরো আগুন জ্বলে ওঠা দেখে ওই চুল্লির কাছাকাছি কাজ করতে থাকা সমস্ত কর্মচারী পালিয়ে যেতে পারে, তাতে ইলেকট্রনিক মেশিনগুলি অকেজো হয়ে যাবে।
একটি জ্বালানি রড তৈরিক কোম্পানিতে চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আরনি গুন্ডারসেনের মতে, ৪ নং ইউনিটের কোরের কাছে থাকা জ্বালানি কুলুঙ্গীটি বেঁকে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঠুনকো দশায় এসে পৌঁছেছে, যে কোনও সময় ভেঙে পড়বে। ক্যামেরাতে দেখা গেছে, জ্বালানি কুলুঙ্গীটিতে ধ্বংসের চিহ্ন।
৪ নং ইউনিটটি খালি করার প্রাযুক্তিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলির বাধাগুলিও অভূতপূর্ব। কিন্তু এটা করতেই হবে, এবং ১০০ শতাংশ সঠিক ভাবে।
এই প্রয়াসে ব্যর্থ হলে জ্বালানি রডগুলি বাতাসে উন্মুক্ত হয়ে যাবে এবং আগুন ধরে যাবে, আবহাওয়ায় মিশে যাবে ভয়ঙ্কর পরিমাণ তেজস্ক্রিয়তা। কুলুঙ্গীটি মাটিতে ভেঙে পড়লে জ্বালানি রডগুলি মাটিতে একসাথে এর ওর ঘাড়ের ওপর পড়বে, ফিশন হয়ে যেতে পারে, বিস্ফোরণও হতে পারে। যে তেজস্ক্রিয় মেঘটি এর মধ্যে দিয়ে তৈরি হবে, তা আমাদের সকলের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে।
১৯৮৬ সালের চের্নোবিলের তেজস্ক্রিয়তা ক্যালিফোর্নিয়া পৌঁছেছিল দশ দিনে। ২০১১-র ফুকুশিমার তেজস্ক্রিয়তা পৌঁছতে সময় লেগেছিল সাত দিনেরও কম। ৪ নং ইউনিটের জ্বালানিতে আগুন লাগলে তার থেকে তেজস্ক্রিয়তা আমাদের বিষাক্ত করতেই থাকবে কয়েক শতাব্দী ধরে।
প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মিৎসুহেই মুরাতা বলেছেন, ফুকুশিমা থেকে পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় বিকিরণ হলে, ‘তাতে বিশ্বের পরিবেশ এবং আমাদের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এটা কোনও জটিল বিজ্ঞান নয়, পরমাণু প্রকল্প নিয়ে কোনও কূটতর্ক-ও নয়। এটা মানব সভ্যতার টিঁকে যাওয়ার প্রশ্ন।’
টোকিও ইলেকট্রিক বা জাপান সরকার, কেউই একা এই আসন্ন বিপর্যয় মোকাবিলা করতে পারবে না। এই গ্রহের সর্বোত্তম বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারদের একটি সম্মিলিত টিম পাঠানোর কোনও বিকল্প নেই।
আমাদের হাতে আর দু-মাস রয়েছে এই কাজ করার জন্য। ঘড়ি দৌড়চ্ছে। বিশ্বের পরমাণু ইন্ডাস্ট্রি হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে রাত পোহানোর অপেক্ষায়।
Leave a Reply