আমাদের দেশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির এক দশক অতিক্রান্ত। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে জিডিপি বাড়ছে, কিন্তু কমছে মানুষের চাকরি বা কাজ। জিডিপি-র প্রায় দুই তৃতীয়াংশই পরিষেবা ক্ষেত্রের সম্পদ, কিন্তু ওই ক্ষেত্রে দেশের মাত্র এক চতুর্থাংশ লোকের চাকরি/কাজ হয়েছে। কৃষিতে নিয়োজিত অর্ধেক মানুষ — কিন্তু জিডিপিতে তার অবদান মাত্র সতেরো শতাংশ। বাকি পড়ে থাকছে শিল্প। আরো স্পষ্ট করে বললে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, বা উৎপাদনী শিল্প। এইটার কিন্তু কর্মসংস্থান এবং জিডিপিতে অংশীদারী প্রায় সমান সমান। তাই লোকের কাজের বন্দোবস্ত করতে হলে পড়ে থাকছে এই ক্ষেত্রটিই। নাহলে জনমানসে নিষ্কর্মা অর্থনৈতিক বৃদ্ধির আর গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।
পুঁজিনীতির এই ফর্মূলা মেনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আয়োজন করেছেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। সারা পৃথিবীর ম্যানুফ্যাকচারি কর্পোরেটদের আহ্বান করেছেন তিনি : ভারতে মাল বানান। বিদেশে বেচুন। ভারতকে শুধু পণ্যের বাজার ভাববেন না। এখানে উৎপাদন করুন। তাহলে লোকে চাকরি/কাজ পাবে, ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। আপনারই বাজার থাকবে, বাড়বে। ভয় নেই, ‘আপনার টাকা মার যাবে না’। দেখার দায় সরকারের।
অনেকটা এইরকম উৎসাহেই এক দশক আগে ভারত সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ‘সেজ’ বানিয়েছিল। সেখানে কর্পোরেটদের খুব মজা, কারখানা বসাতে দেশের চালু আইনকানুন না মানলেও চলে। শ্রম আইনের বালাই নেই। শ্রমিক ইউনিয়নের বালাই নেই। হাজারগণ্ডা লাইসেন্স বা অনুমতির বালাই নেই। ২০০৬ সাল থেকেই জমি অধিগ্রহণবিরোধী জনআন্দোলনগুলি সেজ-এর নামকরণ করেছিল — দেশের ভেতর বিদেশ। কয়েক বছর যেতে না যেতেই দেশজুড়ে সেজগুলি মুখ থুবড়ে পড়েছে। রপ্তানি তলানিতে। বিদেশে পণ্যের বাজার মন্দা। লগ্নি পড়ে থাকছে। টাকা মার যাচ্ছে।
এবার তাই আর সেজ নয়। গোটা দেশেরই শ্রম আইনের দফারফা করার বন্দোবস্ত — যা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে রাজস্থানে। অনুমতি/ছাড়পত্রের তোয়াক্কা না করে কর্পোরেটদের পথ মসৃণ করে দেওয়া — স্বশংসাপত্র। গোটা দেশেই পরিবেশ ছাড়পত্রের ঢালাও বন্দোবস্ত। কর্পোরেট আর সমাজের ভারসাম্য রক্ষার চিরাচরিত ভূমিকায় নয়, সরকার এবার কর্পোরেটের সহায়ক, মোদির ভাষায়, ‘ফ্যাসিলেটেটর’। টাকা মার না যাওয়ার গ্যারান্টারও বটে!
দেশের ভেতর কোনো বিশেষ অঞ্চল নয়, এবার গোটা দেশটাই বিদেশ — ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কি তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে না?
Leave a Reply