শমীক সরকার ও অলোক দত্ত, কলকাতা, ১২ সেপ্টেম্বর#
সাইকেল ধীরে চলে, এই অজুহাতে কলকাতার আটত্রিশ-টা রাস্তায় সাইকেল চালানো, এমনকি দাঁড় করিয়ে রাখা আইনত নিষিদ্ধ হয়েছে (সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা) ২০০৮ সালের আগস্ট মাস থেকে। সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতায় যারা সাইকেল চালায়, তাদের মধ্যে থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেছে। ভবানীপুরের যদুবাবুর বাজারের সাইকেলজীবিদের সংগঠনের তরফে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে স্বাক্ষর সংগ্রহ, বালিগঞ্জ থেকে সাইকেল মিছিল (যা পুলিশ আটকে দেয় গড়িয়াহাটে), হাজরায় পথসভা সংগঠিত করা হয়েছে। সাইকেল সমাজ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে কলকাতায় ছ’টি জায়গায় গণ-স্বাক্ষর সংগ্রহ, পরিবেশ দিবসে সারাদিন অবস্থান, পোস্টার নিয়ে সাইকেল যাত্রা এবং প্রচারপত্র ও পুস্তিকা বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংবাদমন্থন পত্রিকায় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই ধারাবাহিকভাবে কলকাতায় সাইকেল চালকদের ওপর পুলিশি জুলুমের সংবাদ বেরিয়েছে। এই কাগজের এক প্রতিবেদক কলকাতা পুলিশের সাইকেল নিষেধাজ্ঞা বেআইনিভাবে বলবৎ করার সময় অকুস্থলেই তার বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করতে গেলে দু-বার পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেছে, গড়িয়াহাটে এবং শ্যামবাজারে। ঢাকুরিয়াতে লেক থানার সঙ্গে যোগসাজোশে কলকাতা সাউথ ট্রাফিক গার্ডেদের সাইকেল আটকে বেআইনিভাবে ১০০ টাকা জরিমানা নেওয়ার ঘটনা ক্যামেরাবন্দী করে পত্রিকায় ছাপিয়ে তা লালবাজার এবং লেক থানাকে দেওয়াও হয়েছে। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে সাইকেল ধরার সময় সরাসরি ট্রাফিক পুলিশকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো ঘটনা ঘটেছে আকছাড়। বড়ো বড়ো মিডিয়ায় সাইকেল নিষেদের আইনের কথা খুব একটা আসেনি আগে। বরং আনন্দবাজার পত্রিকা কয়েকবছর আগে তার একটি সাপ্লিমেন্টারি পাতায় মুদিয়ালি-তে সাইকেল নিষেধের আইন থাকা সত্ত্বেও কেন পুলিশ তা কঠোরভাবে পালন করছে না, সেই নিয়ে ছবি দিয়ে বিশাল এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদক ছিলেন দীক্ষা ভুঁইয়া।
অবশেষে সাধারণ মানুষের সাইকেল নিষেদের প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এলিট সমাজের মধ্যেও, তার জের-এ এমনকি আনন্দবাজারের মতো বড়ো মিডিয়াও সাইকেল নিষেধের বিরুদ্ধে উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখছে। ঘটনার সূত্রপাত মাসখানেক আগে, ডাউন-টু-আর্থ নামে একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি সাময়িকী-তে সায়ন্তন বেরা-র একটি বড়ো এবং সুলিখিত প্রবন্ধের হাত ধরে। কয়েকদিনের মধ্যেই ওই প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রিত হয় ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যানের রবিবাসরীয় পাতায়। তার কয়েকদিনের মধ্যেই ওই প্রবন্ধের সূত্র ধরে (এবং ওই প্রবন্ধের কথা উল্লেখ না করে) গ্রীনপিসএক্স নামে একটি এনজিও সংগঠন ইন্টারনেট-এ কলকাতায় সাইকেল নিষেধের প্রতিবাদে ইন্টারনেট-এ স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করে। উল্লেখ্য, কলকাতায় যারা সাইকেল চালায়, তাদের প্রায় সিংহভাগই শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ, ইন্টারনেট তো দূরস্থান, তাদের কারোর কারোর মোবাইল-ও নেই। যাই হোক, এরপর রাইট টু ব্রিদ নামে একটি সংগঠনের কয়েকজন একটি সাইকেল র্যালি করে, যার খবর বেরোয় টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায়। তারপর গত ৮ সেপ্টেম্বর সকালে কলকাতার চৌরঙ্গীর ভিক্টোরিয়া হাউস থেকে প্রেস ক্লাবের বাইরের অংশ পর্যন্ত শতাধিক সাইকেল ও মানুষ হেঁটে যায়। পরদিন বিভিন্ন বড়ো মিডিয়াতে এর রিপোর্ট বেরোয়।
৮ সেপ্টেম্বরের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বানী ঘোষ, যিনি প্রাক্তন সাইক্লিস্ট এবং পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের বিভিন্ন সাইকেল সংগঠনের পদাধিকারী। এছাড়া ওইদিনের সভায় উপস্থিত ছিল রাইট-টু-ব্রিদ সংগঠনের মানুষরা। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের একটি সাইকেল দোকান ১৬-১৭টি সাইকেল ও কিছু লোক দিয়ে এই অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করে। ছিল দুটি সাইকেল কোম্পানির দেওয়া সাইকেলপ্রেমী গেঞ্জি। ছিল বেশ কিছু পোস্টার। তবে এই অনুষ্ঠানে কোনও স্লোগান বা বক্তব্য ছিল না। মিডিয়ার লোকেদের কাছে অবশ্য বক্তব্য রাখা হয় প্রেস ক্লাবের বাইরে। একবার কয়েকটি সাইকেল মাথার ওপরে তুলে ধরে হিপ হিপ হুররে ধ্বনি দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, চৌরঙ্গী থেকে প্রেস ক্লাবের এই রাস্তাটি কঠোরভাবে সাইকেল নিষেধের আওতায়, এবং এই রাস্তাটায় সাইকেল চালিয়ে যাওয়া মানুষ খুব কম যাতায়াত করে। এই অনুষ্ঠানের পর এনএপিএম-এর পক্ষ থেকে মেধা পাটেকর সাইকেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেন।
বছর দুই আগে যাদবপুর গড়িয়া থেকে শুরু করে মেটিয়াব্রুজ অবদি বিস্তীর্ণ এলাকা পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের আওতা থেকে কলকাতা পুলিশের আওতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার বিভিন্ন রাস্তায় কলকাতা পুলিশের হোর্ডিং দেখা যাচ্ছিল, ‘ধীর গতির যানবাহন নিষেধ’। এবছর জুন মাসে পরিবেশ দিবসের প্রাক্কালে সরাসরি সাইকেল নিষেধের হোর্ডিং ঝুলিয়ে দেওয়া হয় যাদবপুর, গড়িয়া, আনোয়ার শাহ রোড প্রভৃতি এই সংযুক্ত অঞ্চলে। এই সব হোর্ডিং-এ অবশ্য কোন সময় থেকে কোন সময় সাইকেল নিষিদ্ধ, সেকথা বলা ছিল না। এই নতুন হোর্ডিং নিয়ে ডাউন-টু-আর্থের প্রতিবেদক সায়ন্তন বেরার প্রশ্নের উত্তরে লালবাজারের ট্রাফিক পুলিশের বড়োকর্তা জানান, এগুলো যদি অর্ডারে না থেকে থাকে, তাহলে শীঘ্রই নতুন অর্ডার বানিয়ে দেওয়া হবে। তারপর নতুন অর্ডারে অন্তর্ভুক্ত হবার পর দেখা যায়, ৩৮টি রাস্তা থেকে বেড়ে ১৭৪টি রাস্তায় সাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় পুরো কলকাতাতেই।
উল্লেখ্য, যে আইনবলে এই অর্ডারগুলি দিতে পারে কলকাতা পুলিশ, সেই ১৯৬৫ সালের ট্রাফিক আইনে বলা আছে, এইরকম অর্ডার বড়োজোর দু-মাসের জন্য দিতে পারে কলকাতা পুলিশ। তার বেশি সময় জুড়ে এইরকম অর্ডার রাখতে গেলে রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের অনুমতি নিতে হবে।
Leave a Reply