সৌমাভ দাস, শান্তিপুর, ১৩ জানুয়ারি#
বেঙ্গল স্কুল ও তার পরবর্তী সময়ের বিশিষ্ট্য শিল্পী, শান্তিপুর অধিবাসী, ললিত মোহন সেন-এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রতিবারের মতো এবারও ‘ললিত মোহন সেন স্মারক বক্তৃতা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল শান্তিপুর শরৎকুমারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। উদ্যোগে মূলতঃ শিল্পীর আত্মীয় ও শান্তিপুরের শিল্পানুরাগী মানুষজন।
এবারের আলোচনার বিষয় ছিল বাংলা সাহিত্যে অলংকরণ। বক্তার ভূমিকায় প্রণবেশ মাইতি। এছাড়াও অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন শিল্প সমালোচক দেবদত্ত গুপ্ত, বর্তমানে ললিত মোহন সেনের ছবির কিউরেটর এবং আজকাল পত্রিকার গ্রন্থাগারিক দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়।
নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠান শুরুতেই সঞ্চালক অনিন্দ্য মোদক, উজান চট্টোপাধ্যায় নামক এক কিশোরের গান দিয়ে অনুষ্ঠানের সুর ধরিয়ে দেন। আয়োজকদের তরফে অতিথিদের উত্তরীয় প্রদান করে বরণ করে নেওয়া হয়। অতিথিগণ একে কে শিল্পী ললিত মোহন সেন-এর ছবিতে পুষ্পার্ঘ্য দেন।
মূল অনুষ্ঠানের শুরুতে দেবদত্ত গুপ্ত কথায় অলংকরণের সেই পরিচয়টা পাওয়া যায় যেখানে তা লেখার পরিপূরক হয়ে ওঠে। মূল বক্তা শিল্পী প্রণবেশ মাইতি আলোচনার পুরোভাগে অলংকরণবিষয়ক কিছু তথ্য ভিত্তিক ও শিল্পভিত্তিক আলোচনা করেন। তাঁর কথায় জানা গেল ১৭৭৮ সালে শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হল্যান্ডের ইংরাজী ভাষায় লেখা বাংলা ব্যকরণ-এর নামপত্রটিই সম্ভবত বাংলাতে প্রথম অলংকরণ। প্রচ্ছদে ছিল বই ও লেখকের নাম, কোন প্রেসে ছাপা হয়েছে ইত্যাদি। আধুনিক যুগেও এই ধারাটি মেনে চলা হয়। শিল্পী আলোচনা করলেন অলংকরণের গতি, তাতে মাধ্যমের ভূমিকা-ব্যবহার, মাধ্যমের পরিবর্তন, বিবর্তন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়।
এরপর প্রণবেশ মাইতি স্লাইডের মাধ্যমে বেশ কয়েকজন শিল্পীর প্রচ্ছদ দেখান। প্রচ্ছদে ক্যালিগ্রাফিক প্রভাব কতটা, কতটা বলা উচিৎ বা কতটা নয়, শিল্প রুচি ইত্যাদি ফুটে উঠল। গোয়েন্দা বিষয়ক একটি গ্রন্থের প্রচ্ছদ দেখাতে গিয়ে শিল্পী বলেন, গোয়েন্দা গল্পের প্রচ্ছদে বেশী কথা না বলাই ভালো, তাতে উত্তেজনাটা বজায় থাকে। এই ধরণের কিছু শিক্ষণীয় ও প্রয়োজনীয় মন্তব্য দর্শক মনকে সত্যিই সমৃদ্ধ করে। শিল্পীর ব্যখ্যায় লীলা রায়ের প্রচ্ছদে ক্যালিগ্রাফিক গুণ রবং অল্পের মাধ্যমে অধিক ব্যাখ্যা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচ্ছদ, সত্যজিৎ রায়ের ‘দ্বন্দ্ব’ নামক বইয়ের প্রচ্ছদে কি অবলীলায় রেখার কাটাকুটিতে দ্বন্দ্ব গড়ে তোলেন বা তাঁর ‘কাঞ্চনজঙ্গা’-র পোস্টারে দূরদৃষ্টির ব্যবহার ও ‘টংলিং’-এর প্রচ্ছদে হাস্যরসের উপকরণ; আহত পাখির মতো ডানা ঝাপটায়’ ও পূর্ণেন্দু পত্রী কৃত প্রচ্ছদে হস্তাক্ষর কিভাবে আহত পাখির ডানাতে রূপান্তরিত হয় সবই চাক্ষুষ করা গেল। আলোচনা চলাকালীন ‘পদ্মানদীর মাঝি’-র একটি প্রচ্ছদ কতটা প্রাসঙ্গিক তা নিয়ে শিল্পী ও দেবদত্ত গুপ্তের মধ্যে দুপাক্ষিক কথোপকথন শ্রোতাদের মনকে উৎসাহিত করে তোলে। সমগ্র অনুষ্ঠানটি ঈষৎ ছোট হলেও দর্শকদের প্রাপ্তির বিচারে তা কখনই কম নয়।
অনুষ্ঠানের মধ্যেই প্রকাশিত হয় রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সত্যজিৎ চৌধুরীর গ্রন্থ ‘রবীন্দ্র চিত্রকলা’। এর আগে ‘রবীন্দ্র চিত্রকলা’ বিষয়ক ললিত মোহন সেন স্মারক বক্তৃতা দিয়েছিলেন সত্যজিৎ চৌধুরি।
Leave a Reply