দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য, কোচবিহার, ১৮ অক্টোবর#
এবারের দুর্গাপূজার শেষটা ভালো হলো না। এ কথা সত্যি যে আমাদের দেশে চারজন মানুষের মৃত্যুটা কোনো ব্যাপারই নয়; মানুষ বেশি, মানুষের মরে যাবার ব্যাপারটাও জলভাত। তবুও পরদিন খবরের কাগজে যাদের হঠাৎ করে মরে যাবার কথা প্রকাশ হলো, তারা কোনো না কোনো ভাবে আমার চেনা। আর সেজন্যই হয়ত এই চারটে মরে যাওয়া নিয়ে বেড়িয়ে এলো দোমড়ানো মোচড়ানো কিছু কথা।
বাড়ি থেকে দুপা হাটলেই ওদের বস্তি। ওখানকারই মানুষ শম্ভু রিক্সাওয়ালা আর তার মা, সুনীল গাছ কাটিয়ে আর তার বউ। শম্ভু নবমীর দিন আমাদের ঠাকুর দেখতে নিয়ে গিয়েছিল। ২৪-২৫ বছরের একটা উঠতি ছেলে। আমার বাবা বিয়ে কবে করবি জিগ্গেস করতেই,ওর মুখে একটা লজ্জাওয়ালা হাসি।
রেলের জমিতে এদের বছরের পর বছর ধরে বসবাস। ট্রেন ব্যাপারটা যেন ওদের জীবনের একটা রোজকার অংশ। ট্রেন থেকে দুহাত দুরে ওদের রান্নাঘর, শোবারঘর। ট্রেন লাইনের পাশেই জন্ম, স্নান, খাওয়া, ভালবাসা আর মরে যাওয়া। এই মরে যাবার ব্যাপারটা যে সবকিছুর থেকে বেশি করে সে রাত্তিরে সত্যি হয়ে উঠবে, তা বোধ হয় ওরা কোনদিনও ভাবে নি।
কাল রাতটা বিজয়া দশমীর ছিল না। কিণ্তু কাল রাতে ছিল দুর্গাঠাকুরের ভাসান। ছিল লম্বা প্রসেসান, দুদিন ধরে অবহেলায় পড়ে থাকা মূর্তিটা নিয়ে শেষ আনন্দটুকু লুটে নেবার আপ্রাণ প্রয়াস। ছিল অনেক আলো, ঘামে ভেজা অনেক শরীর, অনেক ধরনের গন্ধ। কিছু সচেতেনতা আর অসচেতনার মাঝে আর ছিল এক ট্রাক ভর্তি sound-box আর তার থেকে বেড়িয়ে আসা সমস্ত শব্দ ছাপিয়ে, ছড়িয়ে পরা আওয়াজ। এবারের পুজার sensation।DJ এর music। বোকা মানুষগুলো জানতই না, এই আওয়াজের ছলে এসে হাজির হবে ওদের শেষবারের মত দুর্গাঠাকুর দেখা।মৃত্যুর অত কাছাকাছি বছরের পর বছর ধরে থাকার জন্যে মানুষগুলো বুঝতেই পারেনি, ট্রেন ছুটে আসছে।
আমি জানিনা এটা কার দোষ, ট্রেন ড্রাইভারের?? যে লাইনের কাছে ভাসানের যাত্রা দেখেও ট্রেন ধীরে করার চেষ্টা করেনি?
প্রশাসনের? যারা ট্রেন লাইনের উপর বিপজ্জনক ভাবে বসবাস করা লোকেদের ওখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার কোন ব্যবস্থাই করে উঠতে পারে নি?
পূজা কমিটীর? যারা হয়ত ভাবেনই নি DJ এর গানে এত অনর্থ লুকিয়ে থাকতে পারে।
অথবা, ওই চারজনের? এটা ওদেরই নিছক বোকামি।
প্রথমবার যখন DMU ট্রেন চালু হয়, আমি বেশ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম, সেই অল্প স্বল্প গতিতে চলা ট্রেনের জায়গা যেন এক দানব দখল করে নিল। মনে হচ্ছিল নতুন ট্রেনগুলোর আকার, গতি কেমন যেন বেমানান ওই অঞ্চলের নরমসরম মানুষগুলোর পক্ষে। ভাবলাম, প্রগতি হচ্ছে। এখন বুঝেছি, ওই চারজন মানুষ হল, ওই প্রগতিরই বলি।আজ সকালে দেখলাম সব ট্রেনগুলো ধীরে ধীরে যাচ্ছে, বার বার হুইসিল বাজিয়ে। কি লাভ? এতো থাকবে না বেশীদিন। হয়ত মরবে আরো মানুষ।
আমি আবারও ভাবি, আমাদের দেশে মানুষের জীবনের দাম কি কিছুই নেই? আমরা যে এখনো বেঁচে আছি সেটাও কি আশ্চর্যের নয়?
Leave a Reply