তাপস দাস, ধুবড়ি, আসাম, ১৩ নভেম্বর#
রায়ট বলতে আমরা যেটা জানি — একদল আর একদলকে মারতে যাচ্ছে, এরকমটা এখানে দেখা যায় না। পিনপয়েন্ট করে মারা — ১৯৬০-এর দশক থেকে রায়টের এটাই সাধারণ চরিত্র এখানে। ১৯৬০-৭০ পর্যায়ের রায়টে মুসলমানরা অসমিয় প্রশাসনের সাহায্য পেয়েছিল। কারণটা হল ১৯৫১-এ অসমিয়া হিসাবে মুসলমানদের নাম লেখানো। বাঙালি হিন্দুরা যাতে আধিপত্য না করতে পারে, তাদের তাড়াতে হবে। ১৯৬০ সালের ভাষা আন্দোলন, যেটা বিকৃত রূপ নিয়েছিল দাঙ্গার, সেই সময় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল বাঙালি মুসলমানরা বাঙালি হিন্দুদের পেটানোতে, ধুবড়ি, বিজনি অঞ্চলে। বাঙালি হিন্দুরা কয়েকটা জায়গায় সেটা প্রতিরোধ করতে করেছিল, যার মধ্যে ধুবড়ি টাউনে। ধুবড়ি জেলায় মুসলিমরা ৭৫%, হিন্দুরা ২৫%। কিন্তু ধুবড়ি টাউনে মুসলিমরা ৪০%, হিন্দুরা ৬০%। মোট কথা এখানে বাঙালি হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, যার ফলে এরা প্রতিরোধ গড়তে পেরেছিল। এখানকার গ্রামগুলোতে হিন্দু বলতে কোচ, রাজবংশী। তাদের সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্ক খুবই ভালো। এখানে অসমিয় মুসলিমরা দেশি মুসলিম হিসেবে পরিচিত। মুসলিমদের মধ্যে অসমিয় মুসলিম ও বাঙালি মুসলিম। অসমিয় মুসলিমরা গোয়ালপাড়িয়া ভাষায় কথা বলে, কোচ-রাজবংশীরাও তাই। তারা অসমিয়া বা বাংলা বলে না। কোচ-রাজবংশী গ্রামে অনেক জায়গায় গাঁওবুড়াটা মুসলমান, হয়তো তিন-চার ঘর মুসলমান আছে। কোচ-রাজবংশীদের সঙ্গে মুসলিমদের সংঘর্ষ আজ অবধি হয়নি। ১৯৯২ সালে রাজবংশী এলাকায় বাঙালি হিন্দুদের মুসলিমরা আক্রমণ করেছিল। দেশি মুসলিমরা আটকায়নি, কিন্তু নিজেরা অংশ নেয়নি।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের ঘটনার পরে রায়ট একটা গণ-আকার নিয়েছিল। বাঙালি হিন্দু এলাকায় মুসলিমরা দলে দলে আক্রমণ করেছিল। ভয়ঙ্কর সেই দাঙ্গা, জ্যান্ত মানুষ আগুনের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। বাঙালি হিন্দুরা যখন পাল্টা আক্রমণ করেছিল, মুসলিমরা কিন্তু বেশি মার খেল। কারণ মিলিটারি, সিআরপি, পুলিশ হিন্দুদের পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল। কিন্তু ২০১২ সালের আগস্ট মাসে দেখা গেল, ধুবড়ি জেলায় মুসলিমরা বড়োদের ওপর আক্রমণ করল। বাঙালি হিন্দুদের তারা ছুঁলো না।
২০১২-র সেপ্টেম্বরে কার্ফুর সময়, ধুবড়ি টাউনের হিন্দু এলাকায় মিশন রোডে কালী মন্দিরে মূর্তি ভাঙা হল, গয়না চুরি হল। সম্ভবত এটা গট আপ গেম। ওরকম হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় মুসলিমদের ঢুকে এই কাজ করা খুবই মুশকিল। এরপর বাঙালি হিন্দু শিবিরের হামলা ভয়ঙ্কর আগ্রাসি রূপ নেয়। একজন মুসলমান সাংবাদিককে হত্যা করা হয়। এর পাল্টা হিসেবে নবমীর রাত দেড়টার সময় একজন ইলেকট্রিশিয়ান যখন সব লাইট ইত্যাদি খুলছিল, তাঁকে মুসলিম দুষ্কৃতিরা ভোজালি দিয়ে কোপায়। এরপর ছিল বকরিদ। অন্য প্রদেশে যারা কাজ করতে যায়, সেই মুসলিমদের মধ্যে অনেকে বাড়ি ফিরছিল হিন্দু পাড়ার মধ্য দিয়ে। সেই সুযোগে অনেককে মেরে ফেলা হয়। সংখ্যা জানা যায়না। এইভাবে চলতে চলতে এখন কিছুটা শান্ত। কিন্তু ওই অশান্তির সময়ে যখন মিলিটারির টহলদারি রয়েছে, অদ্ভুত রটনা আর গুজব চলছিল। শোনা গেল, একজন হিন্দুকে মেরে ফেলা হয়েছে, অন্য সূত্রে একই সময়ে জানা গেল, একজন মুসলমানকে মেরে ফেলা হয়েছে। কারা রটাচ্ছিল এইসব? একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের অনুমান করা যায়। তাতে কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীও থাকতে পারে, যাদের হিন্দু-মুসলমান দুই সমাজের মধ্যেই সমর্থক আছে।
Leave a Reply