দক্ষিণ কোলকাতার ১০৫নং ওয়ার্ডের হালতু নেলীনগর কলোনিতে দীর্ঘদিন বসবাস করেন আশালতা দাস (বর্তমানে আশির উপর বয়স)। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি তাঁর ভাড়ার ঘরটিতে পড়ে গিয়ে কোমরে চোট পান। ওঁর চিৎকারে আশেপাশের কেউই আসে না। কয়েকটা বাড়ি পরে দূরসম্পর্কের এক নাতি (এদের বাড়ির সঙ্গে আশালতা দেবীর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, কিন্তু তাঁর নিজগুণেই তিনি এদের বাড়ির সহানুভূতি হারিয়েছেন) কলেজ ছাত্র সুরজিৎ ইন্দ্র তাঁকে তুলে নিয়ে প্রথমে যাদবপুর কেপিসি হাসপাতাল এবং পরে টালিগঞ্জ ভাঙ্গর হাসপাতাল ভর্তি করে। এর পর থেকে প্রায় দেড় মাসের ওপর সময় ধরে বৃদ্ধার চিকিৎসার সমস্ত দায় ভার সুরজিৎকেই নিতে হয়। পাড়া-পড়শি বা আত্মীয়-স্বজন সবাই অসুস্থ আশালতাদেবীর দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক। ভাঙ্গর হাসপাতালে বৃদ্ধার একটি অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু সেই সময় অভিভাবকদের স্বাক্ষর করতে একমাত্র উপস্থিত থাকে সুরজিৎ। প্রায় প্রতিদিন হাসপাতালে যাওয়া ওষুধপত্র কিনে দেওয়া, ডাক্তারের সাথে কথা বলা এই সমস্ত কাজই সুরজিৎকে একাই করতে হয়।
পাড়ার নামী ক্লাব কে কে দত্ত মেমোরিয়াল ক্লাবের কাছে সাহায্য-সহযোগীতা চাইলে তারা এ জাতীয় দায়িত্ব নিতে অপারগ বলে জানায়। এরকম সহায় সম্বলহীন একজন অসুস্থ বৃদ্ধার দায়িত্ব বহন করা ক্লাবগুলির কাজ নয়। তবে কি তাদের কাজ বিভিন্ন ভাবে ক্লাবের বিল্ডিং বানিয়ে তাকে ভাড়া দিয়ে অর্থ উপার্জন? এবং বছরে ঘটা করে পূজা করে নাম ফাটানো? সামাজিক সংকটে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর মতো দায়িত্ব পালনে এই ক্লাবগুলি অক্ষম।
৬ দিন আগে তাঁকে হাসপাতাল ছেড়ে দেয়। হাসপাতাল থেকে তাঁকে ভাড়া বাড়িতে নিয়ে এলে বাড়িওয়ালা আপত্তি জানায়। একা ঘরে তাঁকে দেখবার মতো কেউ নেই। তাই বাড়িওয়ালা তাঁকে আর থাকতে দিতে চায় না। বৃদ্ধার চিকিৎসার জন্য পাড়ার থেকে কিছু অর্থ সাহায্য তোলা হয়েছিল। এখন তিনি তাঁর ৬ ফুট বাই ৭ ফুটের টালির ভাড়া ঘরটিতে শুয়ে আছেন মাটিতে। গত চার দিন ধরে তিনি কিছু খাচ্ছেন না। পাড়ার কেউ কেউ বলছেন ওঁকে রাস্তায় কোনো ঝুপড়িতে ফেলে আসা হোক। কেউ বলছে হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও। কিন্তু পাঠাবে কে? আমার ছাত্র সুরজিৎ আমাকে আগে বিষয়টি জানিয়ে ছিল। আমি ওর এই মানবিক বোধকে সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। কিন্তু ততটা গুরুত্ব দিইনি।
কিন্তু ও সেদিন ফোন করে ওর অসহায় অবস্থার কথা জানালে আমি দেখতে যাই, এক বন্ধুকে নিয়ে। ঘরের থেকে সামান্য গন্ধও বেরোচ্ছে। ডান পায়ের একটা অংশ কেটে গেছে, কোনোরকম চিকিৎসা হয়নি। কোমরে যেখানে অস্ত্রোপচার হয়েছিল, সেখানেও সম্ভবত ইনফেকশন হয়ে গেছে। উনি এখন আর কথা বলতে চাইছেন না। ওঁর গায়ে হাত দিতেও দিচ্ছেন না। একটু জল খাচ্ছেন মাঝেমাঝে। আয়া মাসি ঠিক করা হয়েছিল, কিন্তু তাঁরা এসে ওঁর অবস্থা দেখে চলে গেছেন। আমি নিজেও সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারিনি যে ওঁকে পরিচ্ছন্ন শুশ্রূষা দেব। ওঁর একজন বোন আছেন, তাঁর বয়সও আশির ওপর। তিনি রোজ কয়েকবার এসে ওঁকে জল দেন বা কাপড় পাল্টে দেন। সুরজিৎ বৃদ্ধার এই অবহেলার আসন্ন মৃত্যকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। ও চাইছে একটু সম্মানজনক স্বস্তির মৃত্যু।
পুনশ্চ : এই রিপোর্ট লেখার দু’দিনের মধ্যে বৃদ্ধা মারা যান ঘরেই। একাধিক আয়াকে পয়সা দেওয়া সত্ত্বেও সেবিকার কাজ করতে রাজি করানো যায়নি। শেষে মাদার টেরিজার আশ্রমের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল বৃদ্ধাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তারা আসার আগেই বৃদ্ধা মারা যান।
শ্রীমান চক্রবর্তী, হালতু, ৩১ মার্চ
Leave a Reply