২০ ডিসেম্বর, ছন্দা বাগচী, ফার্ণ রোড, কলকাতা#
৯৬ নং ওয়ার্ডে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের অভাব প্রসঙ্গে স্থানীয় এক পরিবেশ কর্মীর আক্ষেপ যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হল। কারণ যত্রতত্র অনুমতির তোয়াক্কা না করে গাছ কাটার প্রবণতা প্রবল। ডাল ছাঁটার নামে গাছের গোড়ায় ইচ্ছাকৃতভাবে পিচ ঢেলে দেওয়া হয়। এর চেয়েও গুরুতর অভিযোগ শোনা গেল সন্তোষপুর ও যাদবপুর কানেক্টর সংলগ্ন ইস্টার্ন বাইপাসের নানান ওয়ার্ডে — বিনা অনুমতিতে বড়ো বড়ো গাছ কেটে পুকুর আর জলাজমি বুজিয়ে পরিবেশ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বহুতল-ব্যবসায়ীদের যথেচ্ছাচার নিয়ে ভুরি ভুরি অভিযোগ ১০১, ১০২, ১০৩, ১০৬, ১০৯ নং ওয়ার্ডের পরিবেশপ্রেমী নাগরিকদের। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পুরপিতারা নিরুত্তাপ। ১০১নং ওয়ার্ডে বাম পুরপিতা গড়িয়া খাল সংস্কারে উদ্যোগী হওয়ায় মশার উপদ্রব অনেকটাই কমেছে বলে দাবি করলেন খালপাড়ের এক পুরোনো বাসিন্দা, স্থানীয় দুর্গাপুজো কমিটির সভাপতি। জঞ্জাল সাফাই নিয়েও তেমন কোনো অভিযোগ নেই বাসিন্দাদের। তবে বাঘাযতীন স্টেশন রোডে পুরবাজারের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বাস রাস্তার মোড়ে শৌচাগারের অভাব নিয়ে পথচলতি মানুষের দুর্ভোগ স্থানীয় কাগজের সংবাদ-শিরোনামে এলেও সুরাহা হয়নি কোনো। ১০৯নং ওয়ার্ড রাজ্য এবং পুরসভার শাসক দলের সদর দপ্তর সংলগ্ন হলেও বস্তি সংস্কার নিয়ে নাগরিকদের দাবিপূরণ না হওয়ায় ক্ষুব্ধ অনেকেই। পুরসভার বিরুদ্ধে মিউটেশন, ট্রেড লাইসেন্স, টেন্ডার, নানা প্রকল্পে কারচুপি আর অনিয়ম নিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতাবাসীর নানান নালিশ থাকলেও ইদানীংকালে সবচেয়ে বিতর্কিত ত্রিফলা আলো যে মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করে শহরের বহু ওয়ার্ডের প্রায়ান্ধাকার পথঘাট আলোকিত করেছে একথা মানলেন অনেকেই। তবে ভেপার ল্যাম্পের আলো যে আরও বেশি আর ত্রিফলার মতো গাছের গায়ে না লাগানোয় পাখিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না — ৯৬নং ওয়ার্ডের পক্ষীপ্রেমীদের এই দাবিও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। তবে ত্রিফলা আর ভেপারে সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল ৬৮নং ওয়ার্ডের অভিজ্ঞতা বিচিত্র!
দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের এই ওয়ার্ডটি গড়িয়াহাট মোড় সংলগ্ন তথাকথিত অভিজাত এলাকায় হলে কী হবে, অপরাধী অধ্যুষিত এই ওয়ার্ড আজও চোর-ডাকাত-লুঠেরাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল, ‘পরিবর্তনের’ পরেও! চারিদিকে এত আলোর নিচে তাই অন্ধকার — বালিগঞ্জের এক ভূমিপুত্রের এই খেদোক্তি উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই, কেন না নিজের চোখেই দেখলাম — যানবাহন, পথচারী মানুষজন আর টিউবওয়েলে জল আনতে যাওয়া আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে থোড়াই কেয়ার করে ফুটবল খেলা নামে গুণ্ডাদের রাস্তা দখলের রাজনীতি, কানে এল মণি মুখার্জি রোডের পোড়ো বাড়ির কুঠরি থেকে প্রতিবেশিদের ‘সাবাড়’ করে দেবার হুমকী! কিন্তু এসবের সঙ্গে পুরসভার যোগ কতটুকু? — ৬৮নং ওয়ার্ডে জঞ্জাল সাফাই বা নিকাশি নিয়ে যাঁদের কোনো নালিশ নেই, বরং বেশি বৃষ্টি হলে রাস্তায় জমা জল তাড়াতাড়ি নেমে যাওয়ায় যারা তৃণমূলী পুরপিতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তাঁরাই যখন প্রশ্ন করেন, চারপাশে এত আলো, তবু বিশেষ বিশেষ রাস্তায় দুষ্কৃতিরা আনাগোনা করলে পুরসভার আলো নিভে যায় কেন? বাম জমানায় পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা ভুঁইফোড় মাতব্বররা পুরপিতার ছত্রছায়ায় কেন? বা একদা নাগরিক কমিটির সদস্য-সমর্থকরা পুর-পরিষেবায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে কেন — তখন কোনো যুৎসই জবাব মুখে যোগায় না পুরপিতার অনুগামীদেরও! তাঁরা কেউ ‘ফোন করবেন না’ বলে লাইন কেটে দেন, কেউ বা ‘বারো ঘন্টা কাজ করে খাই, এবার তবে যাই’ বলে নিমেষে উধাও।
তবে ৬৮নং ওয়ার্ডের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বিস্তীর্ণ এলাকায় জল সরবরাহ চাহিদার অতিরিক্ত হলেও পুরসভার জল যে আদৌ পানযোগ্য নয় — এবিষয়ে সবাই একমত হলেও পুরপিতাকে তুষ্ট রাখতে অনেকেই প্রকাশ্যে জল পরিশুদ্ধ বলে দাবি করে — অথচ লুকিয়ে টিউবওয়েল থেকে নিয়মিত জল সংগ্রহ করে বা পুরসভার জল শোধন করে নেয়! এখানকার আরও বিশেষত্ব আছে — পরপর তিনবার নির্বাচিত পুরপিতার বিরুদ্ধেও ক্ষোভ অভিযোগের অন্ত নেই। মিউটেশন, ট্রেড লাইসেন্স, বাড়ির জমির নকশা অনুমোদন, নির্মাণে ছাড়পত্র — নানা বিষয়ে অনিয়ম আর দুর্নীতির ভুরি ভুরি অভিযোগ নাগরিক আর কর্মসূত্রে এই ওয়ার্ডে নিয়মিত উপস্থিত নানা মানুষের, তবু তিনি এত জনপ্রিয় কেন? এ প্রশ্নের একটাই জবাব মেলে — যোগ্যতর বিকল্পের অনুপস্থিতি। তবে ‘কেএমসি আর টিএমসি অফিস যেখানে, পুরপিতা সেই অংশের উন্নয়নে আগ্রহী’ — এই প্রচলিত অভিযোগ ধোপে টেঁকে না। কেন না ম্যান্ডেভিলা বা বালিগঞ্জ প্লেসে উন্নত পরিষেবার পেছনে এসব রাস্তার সচ্ছল, পরিবেশ সচেতন নাগরিকদের ভূমিকাও যথেষ্ট — যেখানে ওয়ার্ডের বাকি অংশে বনেদিয়ানার ছাপ থাকলেও বেআইনি দখলদার, বহিরাগত সমাজবিরোধী আর আজন্ম ভাড়াটিয়াদের দাপটে পুরোনো বাসিন্দারা কোনঠাসা। বহিরাগতদের পুর পরিষেবা নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না।
গড়িয়াহাটার ফ্লাই ওভারের জন্য ছোটো রাস্তা দিয়ে অত্যধিক ট্রাফিক চলাচল যানজট বাড়ানোয় স্কুল ফেরত শিশুরা দুর্ঘটনায় পড়ে এমন অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গে বড়ো রাস্তার ফুটপাথ জুড়ে হোটেল বসানো, রাস্তা আটকে খেলা, পর্যাপ্ত ফুটপাথের অভাব এবং নিত্য নতুন হকার বসিয়ে ট্রাফিক সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট পুরপিতা-মাতাদের দায়ী করেন ৬৮, ৯০, ৮৫, ৮৬নং ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। বাস্তবে সহজে বাড়তি উপার্জনের নেশা এক শ্রেণীর পুর-প্রতিনিধিদের এমনভাবে পেয়ে বসেছে, ফুটপাথে জায়গা না পেয়ে রাস্তার একপাশে হকার বসানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান সহজ নয়। যেমন, ‘দিদি’র কড়া নিষেধ থাকলেও প্রমোটারি আর নির্মাণ-শিল্পে পুরপিতা ভাইদের বকলমে উপস্থিতির জেরে শহরজুড়ে নানা সমস্যায় নাগরিকরা জেরবার হচ্ছে তার নমুনা কেবল দক্ষিণে নয়, মিলল উত্তর-মধ্য কলকাতার ওয়ার্ড পরিক্রমাতেও।
Leave a Reply