২০ ডিসেম্বর, ছন্দা বাগচী, ফার্ণ রোড, কলকাতা#
তবে তার আগে দেখা যাক, পরিবর্তনের পর কেমন আছে পুরসভার সদর দফতর মধ্য কলকাতার ছোটো লাল বাড়ি — রাজ্য রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে যার অবস্থান, এই সেদিন অবধি ‘চোরপোরেশন’ বদনামে আখ্যাত পুরভবন?
নানান ওয়ার্ড আর বরো অফিস নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের হরেক নালিশ থাকলেও কলকাতা পুরসভার সদর দফতরে যে কর্মসংস্কৃতি অনেকটাই ফিরেছে — ক্ষমতাসীন দল খুব জোরালোভাবে তেমন দাবি না করলেও তার সত্যতা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। বিশেষ করে নব্য প্রজন্মের পুরকর্মীদের ব্যবহার আর কর্মতৎপরতার দৌলতে তিন দশকের গয়ংগচ্ছ মনোভাবের ঐতিহ্য যে ভাঙছে — এটা অবশ্যই পরিবর্তনের প্রাপ্তি। কেননা ২০১০ সালে বর্তমান পুরবোর্ড গঠিত হলেও ২০১১ সাল থেকে যে ক্ষমতাসীন বোর্ড গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে কর্মসংস্কৃতি পুনরুদ্ধারে উদ্যোগী হয়েছে একথা নানা প্রান্ত থেকে পুরভবনে আসা নাগরিকরাও স্বীকার করলেন। একই কথা শুনেছি দক্ষিণের বিভিন্ন ওয়ার্ডেও। তবে সব দপ্তরের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য নয় — যেমন পুরপিতা-মাতাদের সুপারিশ না থাকলে পার্ক ও উদ্যান দপ্তরে কর্মসংস্কৃতির হাল আগের মতোই, জানালেন এক ভুক্তভোগী। পুরসভার গলদ ধামাচাপা দিতে ভারপ্রাপ্ত তথ্য আধিকারিকদের গড়িমসি নিয়েও অভিযোগ বিস্তর। তবে সব মিলিয়ে পরিবর্তনের পর আগের চেয়ে অনেক সুস্থ পুরভবন, যার দেওয়ালের রঙ না পাল্টালেও কাজের ঢং বদলেছে অনেকটাই।
তবে অতীতের তৃণমূল-বিজেপি পুরবোর্ডের মতো এই বোর্ডও দক্ষিণের প্রতি বেশি সদয় — এ অভিযোগ মানা যায় না খোদ মহানাগরিকের খাস ওয়ার্ড তথা গোটা বেহালার বেহাল দশা দেখে। জল জমা, জঞ্জাল আর নিত্য যানজটে জেরবার বেহালাবাসীর অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ। বানভাসি বেহালার সচিত্র বিবরণ বর্ষাকালে বার বার খবরের শিরোনামে এলেও মূলত ১২৪, ১২৫, ১২৬ আর ১৩২নং ওয়ার্ডই বর্ষায় জলমগ্ন থাকে — মন্তব্য বেহালাবাসী এক প্রবীণ আইনজীবীর। ১১৮নং ওয়ার্ডের পুরোনো বাসিন্দা, আলিপুর জজ কোর্টের এই আইনজীবী আরও জানালেন, তাঁর ওয়ার্ডে পুরসভার জল সরবরাহ পর্যাপ্ত এবং পরিশ্রুত, জঞ্জাল সাফাইও নিয়মিত। পুর সদস্যর বিরুদ্ধেও দুর্নীতি বা অনিয়মের তেমন গুরুতর অভিযোগ নেই। অতিবৃষ্টিতে জল জমলেও তাড়াতাড়ি নেমে যায়, কিন্তু মশার তেল বা ব্লিচিং পাউডার ছড়ানো হয় না। রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো নেই। নেই ‘সুলভ’ শৌচাগার। ওয়ার্ড অফিসে কর্মসংস্কৃতির কোনো উন্নতিও চোখে পড়ে না। পুরকর্মীদের ‘গয়ংগচ্ছ’ ভাব যেমন আগে ছিল, তেমনই আছে।
বেহালার ১২৬নং ওয়ার্ডে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী চণ্ডীমেলা সংলগ্ন এলাকা অল্প বৃষ্টিতে জলমগ্ন হওয়ায় দর্শনার্থীরা যেমন দুর্ভোগে পড়ে, স্থানীয় অধিবাসীরা ‘বানভাসী’ হয় ১২৪, ১২৫ আর খোদ মেয়রের ১৩২নং ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকায়। আবার ১২৮নং ওয়ার্ডের গুলেপাড়া রোড, শ্যামসুন্দর পল্লিবাসীরা বর্ষা এলেই প্রমাদ গোনে। তবে খাল সংস্কার করে নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়নে কলকাতা পুরসভা থেকে রাজ্যের সেচ দপ্তর যেভাবে তৎপরতা দেখাচ্ছে, আশা করা যায় উত্তরের নানা ওয়ার্ডের সঙ্গে সঙ্গে বেহালার জল জমায় রেকর্ড সৃষ্টিকারী ওয়ার্ডগুলিও অচিরেই উন্নত নিকাশী ব্যবস্থার সুফল পাবে। ১২৮নং ওয়ার্ডের বঙ্কিম পল্লি, বিদ্যাসাগর পল্লি, জয়হিন্দ পল্লির মতো বেহালার নানা ওয়ার্ডে ছড়িয়ে থাকা প্রধানত উদ্বাস্তু অধ্যুষিত এলাকার উন্নয়নেও পুরসভার সচেষ্ট হওয়া উচিত। তবে এই পল্লি অঞ্চল বাদে ১২৮নং ওয়ার্ডে পুরপরিষেবা নিয়ে নাগরিকদের তেমন কোনো অভিযোগ নেই। বরং পুরপিতা নাগরিকদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিধানে যথেষ্ট মনোযোগী বলেই নাগরিকদের একাংশের দাবি। পুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রও যথেষ্ট উন্নত। কিন্তু পুরবিদ্যালয়ের দৈন্যদশা! স্কুলবাড়ি, ক্লাসঘর, আসবাবপত্র — কোনো কিছুর অভাব নেই। শিক্ষকরাও মজুত, কিন্তু ছাত্রছাত্রী না থাকায় স্কুল অচল! ‘এলাকার গরিব রিক্সাচাকলরাও ছেলেমেয়েদের ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে পাঠানোয় পুরসভার স্কুলের এই হাল’ — আক্ষেপ প্রাক্তন ছাত্র শঙ্কর চক্রবর্তীর। কারণ যাই হোক, দক্ষিণে পুরপরিক্রমায় এ এক অভিনব আবিষ্কার বইকি!
তবে সব মিলিয়ে অবাম পুরবোর্ড যে দলেরই হোক, বাম বোর্ডের তুলনায় বেশি কর্মতৎপর হয়, কেউ কেউ এমন দাবি করলেও কর্পোরেশনের চোরপোরেশন নামকরণ যে এখনও অপরিবর্তিত, সে বিষয়ে অনেকেই একমত!
Leave a Reply