আমাদের আশেপাশে নদী নালা খাল বিল পুকুর ডোবা বুজিয়ে ফেলার পাশাপাশি এ যেন নদীর সাথে এক সংলাপ। উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার হাবড়া পৌরাঞ্চলের গ্রাস করা এক নদী — পদ্মার কথা প্রকাশ হয়েছিল পয়লা অক্টোবর ২০১১ সংখ্যার সংবাদমন্থনে, ‘সেই যে মোদের পদ্মাপারের দিনগুলি।’ এবারের প্রতিবেদক তাপস (ঘনা), কামারথুবা, হাবড়া, ২০ নভেম্বর
“ |
বলল, তোকে নিয়ে একটু লিখতে। দেখ্, তোর সুন্দর দিকটা তো এখন খুঁজে নিতে হয়; আর ভূগোলটা তো ইতিহাসের পথে। তুই তো জানিস, এবার ভারী বর্ষায় তোর উথলে ওঠা রূপ দেখে কত কী ভাবি! — ভাবি কী … ছোট্ট-ছোট্ট প্রাণগুলি ছেড়ে গেলাম তোর কোলে … আর একটা কথা, ‘ওদের কিন্তু রাখিস দুধে-ভাতে’। |
কৈফিয়ত |
ছোট্টবেলায়, সেই নব্বইয়ের দিকে মায়ের সঙ্গে আসতাম আমার পদ্মায়। পাট গাছের গোড়া কুড়াতে। চাষ দেবার পর, এগুলো উঠে আসত এবং খুব ভালো জ্বালানি হত। বর্ষার সময় দেখতাম, লোকেদের পাট ধোয়া, মাছ ধরা — টিঙ্কুর দাদুর মাছ ধরার কথা মনে পড়ে, লোকটির মাছ ধরার ধরনটাই ছিল আলাদা। কয়েকবছর আমরা সেখানে চাষও করেছি, ধান লাগিয়েছি, পাট লাগিয়েছি, দিনে রাতে জমিতে জল দিয়েছি। সেই জমিতে যারা কাজ করত, তাদের খাবার দিয়েছি। এরপর চাষ বন্ধ হয়ে এল, সেই জনমজুরদের আর কোনো খবর নেওয়া হয়নি, বিশেষ করে সরো পিসির — জানি না তারা এখন কেমন আছে।
এরপর তোর সাথে যোগাযোগ আমার ফুটবল নিয়ে। বছর সাত আট আগেও পদ্মা তুই প্রতি বছর বর্ষায় জলে ভরে উঠতিস। এবং বছরের বেশিরভাগ সময়ই থাকত জল। জল শুকিয়ে গেলে, মাঠ পরিষ্কার করতাম। শামুক আর শুকনো কচুরিপানা সরিয়ে দিয়ে। বিগত কয়েকবছর বর্ষা অনিয়মিত হতে লাগল, গজিয়ে উঠল অনেক বাড়িঘর। আর আমাদের খেলার মাঠের ভূগোলটাও অনেকবার পরিবর্তন হল। পরিবর্তন হতে লাগল খেলোয়াড়দেরও। ২০১১ সালে বিশাল জল হল। প্রায় সব বাড়ি থেকেই লোকেদের সরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু গত বছর আবার জল হল না। এবছর যখন বর্ষার শুরুতে জল হতে শুরু করল, কামাক্ষ্যা আমি গেঁদো নিজেরা একটা ভেলা বানিয়ে ফেললাম, কলাগাছ কেটে। জল ক্রমাগত বাড়তে লাগল। যারা ঘর বেঁধেছিল পদ্মায়, তারা বড়ো গাড়ির টিউব কিনে, দুটো টিউবের ওপর কাঠের পাটাতন সাজিয়ে যাতায়াত করতে লাগল। গতবার জল নেই দেখে আমার দুটো টিউব ছেড়ে দিয়েছি, এবার বেশ আফশোস হচ্ছে। তবুও এর ওর টিউবের ভেলায় মাঝেমাঝে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম আর দেখছিলাম। সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের রঙের খেলা।
প্রথম কয়েকদিন একধরনের জাল (যে জালে ছোটো চুনো পুঁটিরাও বাধা পড়ে জলের মধ্যে ছটফট করে মরে) দিয়ে সবাই মাছ ধরতে লেগে গেল পদ্মায়। মাছও পাচ্ছিল বেশ। তারপর মাছ কমে আসতে লাগল। মনোজিতদাদা আমাকে এর মধ্যে একদিন বলল, বঙ্কিমরা মাছ ছাড়ার কথা ভাবছে। সবার মতো আমিও একটু অবাক হয়েছিলাম। আমাকে বলা হল, এই মাছের পোনা জোগাড় করতে। সেই হিসেবে আমিও লেগে পড়লাম। গত ১১ নভেম্বর পদ্মা তোর পাড়ে বসে আছি — একা, সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল। বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছি। এমন সময়ে মনোজিতদা ফোনে বলল, কিছু মাছের ব্যবস্থা করা গেছে। আমি যেন আশেপাশের ছেলেদের নিয়ে প্রস্তুত থাকি। সবাইকে গিয়ে যখন বললাম, মাছ ছাড়া হবে, কেউ তো বিশ্বাস করছিল না। অবশেষে মনোজিতদাদা বঙ্কিম মহি ওরা হাজির হল মাছ নিয়ে। গোটা তিনেক জায়গায় মাছগুলো ছাড়া হল। তবে কিছু মাছ অবশ্য মরেও গেল। এরপর ১৪ নভেম্বর আবার সন্ধ্যেবেলায় মাছ নিয়ে এল ছিকড়া হাট থেকে। রতন, ঘোষ, সুজিত সবাই মিলে মাছ ছাড়লাম। ১৫ নভেম্বর সকালে বাড়ি ছিলাম না। বাড়ি এসে শুনলাম, আমার খোঁজ করেছে ওরা। আমিও সঙ্গে সঙ্গে পদ্মার দিকে রওনা দিলাম। দেখি মনোজিতদাদা কিছু বাটা মাছ বালতি করে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রতন ও মনোজিতদাদা টিউবের ভেলায় চড়ে সেই মাছ ছাড়ল। সেইদিন প্রায় দুপুর বারোটার পর বঙ্কিমদা ফোনে বলল, পদ্মায় চলে আসতে। গিয়ে দেখলাম, অনেক ল্যাটা মাছের পোনা, সঙ্গে মহি ও শামিম ছিল। সবাই মিলে শুরু হল মাছ ছাড়ার কর্মযজ্ঞ। ছোট্ট শিশুরা অঞ্জলি ভরে পদ্মা তোর জলে মাছ ছেড়ে দিচ্ছে আনন্দে। স্বতঃস্ফুর্তভাবে ফটো তুলতে যেতেই মনোজিতদাদা বলে উঠল, ফটো তুলে জার্নালিজম হচ্ছে! তবুও মাছ ছাড়ার আনন্দের কয়েকটা মুহূর্ত ধরে রাখার চেষ্টা করলাম।
এবার তোর জলে ধরেছে টান। পদ্মা তোর বুকের পরে গেঁথে তোলা কংক্রিটের কাঠামো জেগে উঠছে — সে কঠিন। আমরা বসে বসে ভাবি! তোর রতন কত কী যে বানায়। চমকে দেয়। আজ দেখি ওর হাতে ফানুশ। পদ্মা তোর বুকের থেকে আলোর দীপ সন্ধ্যাকাশে উড়ে যায়।
Leave a Reply