অমিতাভ সেন, কলকাতা, ২৭ সেপ্টেম্বর#
সদ্য-ছাড়া পুরোনো পাড়ার গলির মুখটা এখন বাঁশের খাঁচায় বন্দি। পুজোর একমাস আগে থেকেই এমন থাকে। গত ৬-৭ বছর ধরে আরও বেড়েছে পুজোর জাঁকজমক। এই পুজোয় ধুনো দেওয়ার দায়িত্ব এখন স্থানীয় বাঙালিদের হাত থেকে চলে গেছে নতুন আসা পয়সাওয়ালা অবাঙালি বাসিন্দাদের হাতে। ছোট্ট জায়গায় এত বড়ো করে পুজো দেখে ছোটোবেলায় রূপকথায় পড়া বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচির কথা মনে পড়ে যায় — এমনটা বলেছিল ওপারের যদুবাবুর বাজারের এক রসিক সবজিওয়ালা।
পাড়ার ভিতরে ঢুকলে মনটা বেশ ঠান্ডা হয়ে যায়। সরু গলির মধ্যে এক চিলতে হাওয়া; তবু একান্ন বছরের পরিচিত বাতাস। জ্ঞান হওয়া থেকে বড়ো হয়ে ওঠার সমস্ত সময়টা এখানেই ছিলাম। এই রাস্তাটার প্রতিটা খোয়া, প্রতিটা বাড়ির প্রত্যেক দেওয়াল, এমনকী নতুন বাড়িগুলো উঠেছে যে পুরোনো বাড়িগুলো ভেঙে তার প্রতি বর্গ ইঞ্চি আমি চিনি। মানুষগুলো পালটে-পালটে গেছে। শুধু নতুন মানুষই আসেনি, পুরোনোরাও পালটে গেছে। না পালটানো এক পুরোনো বন্ধুর বাড়ি এসেছি তার ছেলে ও ছেলের এক বন্ধুকে পড়াতে। পড়াতে পড়াতেই ছাত্রের মোবাইলে ফোন। মেয়ে টুপাই ইউনিভার্সিটি থেকে এ পাড়াতেই পড়াতে আসছিল, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাস্তায় মাথা ঘুরে বসে পড়েছে বন্ধ ভারতী সিনেমার পাশে এক পানের দোকানে। সেখান থেকে সে তার মোবাইলে ফোন করে জানাল — একদম উঠে দাঁড়াতে পারছে না। তাকে ওখানে বসতে বলে আমি আর দুই ছাত্র নব আর অরুণাভ ছুটে বেরোলাম।
আমি ঠিক ছুটতে পারছি না। বাড়ি পালটানোর সময় মাল টানাটানি করে কোমরে ব্যথা হয়েছে। ছাত্র দুজন আবার টুপাইয়ের কাছেও পড়ে। ওরা বলল, ‘আপনি আস্তে আস্তে আসুন। আমরা গিয়ে দিদিকে দেখছি।’ আমি তিনস্টপ হেঁটে যখন পৌঁছালাম দেখি ওরা টুপাইকে নিয়ে ট্যাক্সি করে পুরোনো পাড়ার দিকেই রওনা দিয়েছে। আরেকজন আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
পুরোনো পাড়ার আরেক বন্ধুর বাড়িতে মেয়েকে শুইয়ে রেখে, খানিক সুস্থ করে তারপর তাকে তার টিউশনি বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে, আমার আরেকটা টিউশানি সেরে যখন ফিরলাম তখন টুপাই মোটেই সেরে ওঠেনি। বমি করেছে, মাথা ঘুরছে। আমার হাত ধরে ধরে বাস স্ট্যান্ডে এল। সেখানে রাত ৮-৩০টায় কোনো বাস নেই। বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন, তেলের দাম বাড়ায় বাস কম চালানো ইত্যাদি কারণে বাস খুব কম। একটা ট্যাক্সিও নেই। দুজন বাসের জন্য অপেক্ষমান যাত্রী ট্রাফিক পুলিশের সাহায্য নিতে বলল। কিন্তু খালি ট্যাক্সি না থাকলে পুলিশ কী করবে? শেষে একটা গড়িয়া স্টেশন হাওড়া স্টেশনের মিনিবাসে উঠে মেয়েটা অসুস্থ বলায় কন্ডাকটর ড্রাইভারের পাশে মোটরের ঢাকনার ওপর বসিয়ে দিল তাকে। ভয়ানক গরম। কী করে মেয়ে বসে থাকবে জানি না। যে দুজন যাত্রী মেয়ে অসুস্থ শুনে আমার দিকে তাকিয়েছিল তাদের সিটের সামনে আমি গিয়ে দাঁড়াতেই তারা জানলার দিক দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল। আমি মনে মনে সেই রাস্তার পানওয়ালার কথা ভাবছিলাম — টুপাইকে অসুস্থ দেখে যে চোখেমুখে দেওয়ার জন্য জল এগিয়ে দিয়েছিল, নিজের দোকানের পাশে টুল পেতে বসতে দিয়েছিল।
খানিকবাদে এদিকে ভালো সিট ফাঁকা পাওয়ায় মেয়েকে ডেকে এনে বসালাম। বাস জ্যামে নড়ছে না। মেয়ে বসেও থাকতে পারছে না। বহুকষ্টে বাসস্ট্যান্ডে নেমে একটা রিকশায় মেয়েটাকে তুলে বাড়ি নিয়ে এলাম। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল পুরোনো পাড়ার পুরোনো বাড়ির বাড়িওয়ালাদের ওপর, যারা বারবার বলা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন বাড়িটা না সারিয়ে ফেলে রেখে এমন অবস্থা করল, যার ফলে এই ভারী বর্ষায় আমাদের বাড়িটা ধসে পড়ল, আর আমাদের বাধ্য হয়ে উঠে আসতে হল। এখন মুশকিল হচ্ছে, বারবার ছুটে যেতে হচ্ছে পুরোনো পাড়ায় — ওখানেই আমাদের সব টিউশানি। ফলে শরতের মোহনরূপ যাতায়াতের ধকল ভোলাতে পারছে না। আর নতুন পাড়া হালতুর এক কলোনিতে এসে মনে পড়ে যাচ্ছে একসময় আমাদের মা-বাবাদের ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসার সময় কতটা কষ্ট পেতে হয়েছিল। চলতে চলতে এখানে এসে থেমেছি। চলার পথ থামেনি, সেটা মনের মধ্যে বাঁক খেয়ে ঢুকে যাচ্ছে যেখানে ফাঁকা ঘরে রেডিওতে শারদীয় গান বাজছে — জানি গো আজ হা হা রবে তোমার পূজা সারা হবে নিখিল অশ্রুসাগরকূলে …।
Leave a Reply