গেরুকামুখ জলাধারের বিরুদ্ধে মিশিং ছাত্রদের সংগঠন ণ্ণতাকাম মিসিং পরিন কেবাং’ এবং ণ্ণকৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি’র জনসভা
|
ওই বছরেরই সিকিমে ইদু মিশমি কৌমের পথ অবরোধ, দিবাং মাল্টিপারপাস প্রকল্পের বিরুদ্ধে
২০১০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মিজোরামের সিনলুন পাহাড়ে একাধিক জলাধার নির্মাণের প্রতিবাদে রাজধানী আইজলে বিক্ষোভ. সমস্ত ছবি নীরজ ভাঘোলিকার ও পার্থ দাসের প্রতিবেদন ণ্ণড্যামিং দি নর্থইস্ট’ থেকে নেওয়া।
|
২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে নিম্ন সুবর্ণসিরি নদীর ওপর আসাম-অরুণাচলপ্রদেশ সীমান্তে গেরুকামুখ অঞ্চলে ২০০০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে জনআন্দোলন জনপ্রতিরোধের রূপ নেয়। প্রায় চার হাজার স্থানীয় মানুষ ন্যাশনাল হাইওয়ে ৫২ অবরোধ করে। একটি বিশালাকার ট্রেলার কনস্ট্রাকশনের মালপত্র নিয়ে নির্মীয়মান জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছিল। অবরোধের কারণে তা আটকে যায়। এর আগে সোনিতপুর জেলায় ন্যাশনাল হাইওয়ে ৫২ বরাবর অনেক জায়গায় এই ট্রেলার অবরোধ হয়, পুলিশ শূন্যে গুলি চালিয়ে এবং লাঠিচার্জ করে এই মালবাহী ট্রেলারকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। যাই হোক, প্রতিরোধকারীরা এই ট্রেলার আটকে দেয়। মৌখিকভাবে স্থানীয় প্রশাসন রাজি হয়, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের দিকে কোনো মালবাহী ট্রেলার যাবে না। কেবল তেলের ট্যাঙ্কার যাবে ২০ দিনে একটি। প্রকল্পের ন্যূনতম বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ওইটুকু তেল লাগে।
২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে মোট আটটি সংগঠন মিলে ঘাঘোরে, যেখান থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে রাস্তা বাঁদিকে বেঁকে গেছে গেরুকামুখের দিকে, সেখানে একটি চেকপোস্ট ও প্রতিবাদী ক্যাম্প বসায়। এই চেকপোস্ট থেকে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগামী ন্যাশনাল হাইডেল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনএইচপিসি) ছাড়পত্রধারী গাড়িগুলি আটকানো হতে থাকে, বাকি গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়। চেকপোস্টের অনতিদূরে ক্যাম্পে দিনরাত অন্তত ৫০ জন করে থাকে। এই প্রতিবাদী ক্যাম্পটি লখিমপুর জেলায়। অপরদিকে গেরুকামুখ ধেমাজী জেলায়।
আসাম সরকার প্রথম থেকেই এই জন আন্দোলনকে বিভিন্নভাবে দমন করার চেষ্টা করতে থাকে। প্রথমে এই আন্দোলনকে মাওবাদী আন্দোলন বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়।
২০১২ সালের ১১ মে রাতের বেলা একটি ডিজেল তেলবাহী ট্যাঙ্কার এই চেকপোস্ট পেরিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। ট্যাঙ্কারটিকে ছাড়পত্র দেখাতে বলে চেকপোস্টের ছেলেরা। ট্যাঙ্কারটি তা দেখাতে অস্বীকার করে এগিয়ে যায় গেরুকামুখের দিকে। সেটিকে আটকানো হয় এবং মিটিং ডাকা হয়। অন্যদিকে, এলাকাটি ছেয়ে যায় পুলিশ ও সিআরপিএফ-এ। এরই মাঝে একসময় রব ওঠে, তেলের ট্যাঙ্কারটিতে আগুন লেগে গেছে। দমকল এসে আগুন নেবায়। কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি, তেলের ট্যাঙ্কারের সামনের দিকটায় আগুন লেগেছিল। এরপর সামনের প্রতিবাদী ক্যাম্প ও চেকপোস্ট ভেঙে দেয় পুলিশ। সেই রাতেই পার্শ্ববর্তী গ্রামে গ্রামে ঢুকে অত্যাচার চালিয়ে কিশোর ও মহিলাদের গ্রেফতার করা শুরু করে পুলিশ। মে মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া লোকেরা সবাই স্থানীয়, কেউ চাষি, কেউ দোকানদার, কেউ ছাত্র।
গ্রেফতার হওয়া স্থানীয় মানুষকে পুলিশ এবং জেল হেফাজতে অত্যাচার চালানো হয় বলে অভিযোগ করেছে বন্দীরা। পুরুষ পুলিশরা গ্রেফতার করার সময় মহিলাদের শ্লীলতাহানি করেছে বলেও অভিযোগ আছে। স্বাধীন সাংবাদিক প্রিয়াংকা ভোজপুরীর কাছে এই অভিযোগের সত্যতা স্বীকারও করেছে লখিমপুর জেলার অ্যাডিশনাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ ইমদাদ আলি।
গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে আন্দোলন চলার পর লখিমপুর জেলায় পুলিশের পক্ষ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকার বিনিময়ে যুবকদের ণ্ণস্পেশ্যাল পুলিশ অফিসার’ হিসেবে নিয়োগ করা শুরু হয়। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, ছ-মাস পরে তাদের স্থায়ী করা হবে। এদের মাধ্যমেই গ্রামে গ্রামে আন্দোলনকারীদের খুঁজে বের করছে পুলিশ, জানিয়েছে আন্দোলনকারীরা।
দেশের উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে পাহাড়ি পরিবেশে খরস্রোতা নদী অনেক। সেগুলির সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে ভারত সরকার। এই প্রকল্প হাতে নেওয়ার শুরু থেকেই এই প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষ বিক্ষোভ দেখিয়ে চলেছে।
২০০৮ সাল পর্যন্ত এই বিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সিকিম। ২০০৭ সালের শুরু থেকেই উত্তর সিকিমের লেপচা কৌমের কয়েকটি সংগঠন তিস্তা নদীর ওপর ছ-টি আরও বড়ো জলাধার নির্মাণের বিরুদ্ধে অনশন শুরু করে। লাগাতার এক বছর ধরে অনশন চলার পর রাজ্য সরকার ২০০৮ সালের জুন মাসে উত্তর সিকিমের ছাঙ্গুতে ণ্ণলেপচা সংরক্ষিত অঞ্চল’-এর অন্তর্গত চারটি জলাধার প্রকল্প বাতিল করে, কিন্তু আরও দুটি বড়ো জলাধার প্রকল্প (৩০০ মেগাওয়াটের পানান ও ৪৯৫ মেগাওয়াটের তিস্তা ৪ প্রকল্প) চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।
আন্দোলনকারী সংগঠন ণ্ণঅ্যাফেকটেড সিটিজেন অব তিস্তা’ ওই দুটি জলাধারের বিরুদ্ধে তাদের সত্যাগ্রহ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আরও দাবি জানায়, সিকিমের প্রস্তাবিত ২৭টি বড়ো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পই বাতিল করতে হবে। তবে লেপচাদের মধ্যেই কেউ কেউ এই প্রকল্পগুলিকে সমর্থনও করেছিল। আর বিরোধীরা প্রকল্পের সমর্থক দীর্ঘদিনের শাসক দল ণ্ণসিকিম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’-এর অত্যাচারের ভয়ে ছিল। আন্দোলনকারীরা উত্তর সিকিমে ২০০৭ সালে চালু হওয়া দিকচু জলাধারের দেওয়ালে ফাটলের কথা উল্লেখ করে দাবি জানায়, ভূকম্পপ্রবণ এই সিকিমে বৃহৎ জলাধার নিরাপদ নয়।
প্রসঙ্গত, ১৯৯০ এর দশকে সিকিমে রাথোঙ চু জলাধারের বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছিল। উত্তর সিকিমের বাসিন্দা লেপচা কৌমের ভয়, এই জলাধার নির্মাণ হলে, তার ফলে প্রচুর মানুষ এখানে চলে আসবে, বিপন্ন হবে লেপচাদের অস্তিত্ব। উল্লেখ্য, আমাদের রাজ্যের দার্জিলিং একসময় লেপচা কৌমের বাসভূমি ছিল। তারপর ইংরেজরা সেখানে চা বাগান এবং শহর নির্মাণ শুরু করলে নেপালীরা দলে দলে এসে পাহাড়ের দখল নিয়ে নেয়। এখন দার্জিলিঙে লেপচারা নিশ্চিহ্নপ্রায়।
এরপর থেকে সিকিমে একের পর এক মাঝারি ও বৃহৎ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পবিরোধী লড়াইয়ে শামিল হয়েছে স্থানীয় মানুষ। ২০১২ সালের শুরুতে রাথোংচু নদীর ওপর লেথাং (৯৬ মেগাওয়াট) ও তিং তিং (৯৯ মেগাওয়াট) জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিকিম সরকার। ওই নদীর ওপরেই তাসিডিং-এ আরও একটি প্রকল্প (৯৭ মেগাওয়াট) বাতিল করার দাবি জানিয়েছে পশ্চিম সিকিমের বিভিন্ন জনসংগঠন। এই রাথোংচু নদী সিকিমের সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে পবিত্র। আপাতত তাসিডিং প্রকল্প বাতিলের দাবিতে হওয়া একটি পিটিশন নিয়ে সিকিম হাইকোর্টে মামলা চলছে।
নদীতে উঁচু উঁচু বাঁধ দিয়ে জলাধার তৈরি করে, এবং সেই জলাধার থেকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে জল ফেলে, সেই জলে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার পদ্ধতির নাম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল কায়দা ছিল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, যাতে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। আমাদের দেশে মোট বিদ্যুতের মধ্যে জলবিদ্যুতের পরিমাণ ২১ শতাংশের মতো।
আমাদের দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনক্ষমতা ১৯৯০ সাল অবধি ততটা ছিল না। কিন্তু ১৯৯১ সালের উদারীকরণ নীতির মধ্যে দিয়েই এই বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকে। ১৯৯১ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৬৬,০০০ মেগাওয়াট। ২০০১ সালে তা দাঁড়ায় ১০০,০০০ মেগাওয়াটে, আর ২০১১ সালে দাঁড়িয়েছে ১৮৫,০০০ মেগাওয়াটে।
শমীক সরকার, কলকাতা, ২৯ মে
Leave a Reply