ভয়াবহ বিপর্যস্ত উত্তরাখণ্ডের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগে ত্রাণ সংগ্রহ চলছে। শত শত গ্রাম এবং গ্রামের মানুষ বিপন্ন, গৃহহীন। এছাড়া পর্যটক ও তীর্থযাত্রীরাও বিপদের মধ্যে পড়েছিল। বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিপন্নতার মধ্যে যারা বেঁচে রয়েছে, তাদেরও জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য, চিকিৎসা, বস্ত্র ও আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করা এই ত্রাণ সংগ্রহের আশু লক্ষ্য হওয়া উচিত।
কিন্তু এত বড়ো এক বিপর্যয়ে দীর্ঘমেয়াদি ত্রাণ এবং পুনর্গঠনের দায়িত্বও একই সঙ্গে এসে পড়েছে আমাদের ওপর। সেদিক থেকে কয়েকটা বিষয় খেয়ালে রাখা আমাদের দরকার।
এক, আশু ত্রাণ সংগ্রহের উদ্যম অনেক সময়ই অল্প সময়ের মধ্যে ফুরিয়ে যায়। আরও নানান সমস্যা সামনে এসে পড়ে। তখন উত্তরাখণ্ডের বিষয়টা গৌণ হয়ে যাবে। যেমনটা হয়েছিল সুন্দরবনের আয়লা ঝড়ের সময়। এটা আমাদের খেয়ালে রাখা প্রয়োজন।
দুই, পুনর্গঠন মানে কী? আমরা কোন পুনর্গঠন চাই? উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয়ে আবার সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম বলেছেন, ‘আমরা উত্তরাখণ্ড পুনর্গঠন করব’। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাঙ্ক, এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক ইত্যাদি অতিকায় সব সংস্থার সাহায্য নেওয়ার কথা ঘোষিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারও বিপুল অর্থ ও প্রশাসন নিয়ে মাঠে নামার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এইসব বড়ো বড়ো দাম্ভিক ঘোষণা দেখেই ভয় হয়। কারণ ‘উন্নয়ন’-এর নেশায় বুঁদ এইসব উদ্যোক্তারা ‘গঠন’ বলতে বোঝে বড়ো বড়ো রাস্তা, ইমারত, জলাধার, ড্যাম আর পাকা বাড়ি নির্মাণ। সেই কাণ্ডজ্ঞানহীন উন্নয়নের পথেই পাহাড়ময় উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক বিপর্যয় আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ইতিমধ্যেই জিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অ্যাক্টিং ডিরেক্টর এস কে ত্রিপাঠি বলেছেন, ‘১৫ জুনের বিপর্যয় আবার ঘটতে পারে। হিমবাহের কাঁচা বরফ ভেঙে ঘটনাটা ঘটেছে এবং বিপদের পরিস্থিতি এখনও কেটে যায়নি।’ বিজ্ঞানীদের মতে, কেদারনাথের মন্দির সরাতে হতে পারে। যদি তা নাও সম্ভব হয়, তবে মন্দিরের চারপাশে ঘনবসতি সরাতে হবে। এখনকার মন্দিরের দেড় কিলোমিটার নিচে মন্দাকিনী নদীর বামদিকে ০.৭৫ কিমি লম্বা ও ২০০ মিটার প্রশস্ত একটা জায়গা মন্দিরের পক্ষে নিরাপদ। একথা বলেছেন শ্রীত্রিপাঠি। অতএব, উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে নজরে না রেখে বেপরোয়াভাবে উন্নয়নের যে মডেল চালানো হয়েছে, সেখান থেকে সরে আসতে হবে।
তিন, অনেকেই উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও জনসমাজকে ভুলে পর্যটন ও তীর্থস্থান হিসেবেই ওই অঞ্চলকে দেখতে চায়। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী তো বিপর্যস্ত অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েই প্রথমে কেদারনাথ মন্দির পুনর্গঠনে হাত লাগানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এতে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী এবং দিল্লির কংগ্রেসি নেতাদের আঁতে ঘা লাগে। তাঁরা জানিয়ে দেন, মন্দির তাঁরাই গড়বেন। তড়িঘড়ি আর্কিওলজিকাল সার্ভের লোকেদের ক্ষতির বহর জরিপ করতে কেদারনাথে পাঠান দিল্লির নেতারা। খারাপ আবহাওয়ার দরুন সেই প্রতিনিধিরা ফিরে চলে যান। এসব থেকে বোঝা যায়, উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয়ের সঙ্গে লোক ঠকানো মন্দিরের রাজনীতিকে জড়িয়ে নিতে চাইছে রাজনৈতিক নেতারা। এতে বিশেষ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উত্তরাখণ্ডের প্রকৃত পুনর্গঠন ব্যাহতই হবে।
আমাদের ত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচিগুলিকে এইসব আপদ থেকে মুক্ত হতে হবে।
Leave a Reply