বিকর্ণ, কোচবিহার, ৩১ মে#
কয়েক বছর আগের ঘটনা, উত্তম মণ্ডল নামের ছেলেটা তখন পড়ত মাঘপালা গ্রামের পেটভাতা হাই স্কুলে ক্লাস এইট-এ। পাড়াগাঁ বলতে আমরা যেরকম গ্রামের কথা বুঝি — সেরকমই একটা গ্রাম এই মাঘপালা। গ্রামের স্কুলগুলোতে পড়ে এমন সব ছাত্র-ছাত্রীকেই প্রত্যেকদিন অনেক কাজকর্ম করতে হয়। উত্তমও সেরকম এক ছুটির দুপুরে মাঠে গরুর ঘাস কাটছিল। সেখানেই সে কয়েকটা সুতলি জড়ানো বলের মতো জিনিস দেখতে পায়। কিশোরসুলভ অনুসন্ধিৎসায় একটা বল হাতে নিয়ে কাঁচি (কাস্তে) দিয়ে বাড়ি দেয় তাতে। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। ঘন্টাখানেক জ্ঞান হারিয়ে ওখানে পড়ে থাকার পর গ্রামের দু-একজন তাকে দেখতে পায়, তারাই জল ইত্যাদি দিয়ে কোনোমতে তার জ্ঞান ফেরায়, ততক্ষণে বাঁ হাতের আঙ্গুলগুলো ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত আর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। গ্রামের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা হয় কিন্তু সেরকম লাভ কিছু হয় না। পরে কোচবিহারের হাসপাতালে কিছুদিন থাকার পর কিছুটা সুস্থ হয় সে। তার বাবা ততদিনে জয়পুর থেকে এসেছে। কিছু রাজনৈতিক চাপ আর চিকিৎসার খরচ বহনের প্রতিশ্রুতিতে আর পুলিশে খবর দেওয়া হয় না। প্রতিশ্রুতি রয়ে যায় মুখেই, কিছু পাওয়া যায় না, মধ্যে থেকে উত্তমের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।
দু-বছর পর চোখের দৃষ্টি সামান্য পরিষ্কার হলে ২০০৭ সালে সে আবার স্কুলে ভর্তি হয়। কিন্তু পড়াশোনাতে তখনো খুব সমস্যা, তারপর মাঝখানে দু-বছর সম্পূর্ণভাবে পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন। এসবের মধ্যেই ক্লাস নাইনে ওঠে, রেজাল্টও খারাপ হয় না। এবারে নতুন আসা মাষ্টারমশাইদের সে সাহস করে বলেই ফেলে তার অসুবিধার কথা। মাষ্টারমশাইরা এগিয়ে আসেন, ওনাদের আর্থিক সাহায্যে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে তার চোখের অপারেশন হয়। দুইচোখ থেকে প্রায় ১৫ টা পাথরের কুচি বেরোয়। কিন্তু রেটিনার খুব কাছাকাছি চলে যাওয়া একটা বড়ো আকারের কুচি এখনো রয়ে গিয়েছে ভেতরে। আবার একটা বছর নষ্ট হয়।
কিন্তু এবার উত্তমের ভেতরে একটা জেদ এসে গিয়েছে — যেভাবেই হোক পড়াশোনা বন্ধ করা যাবে না। মাধ্যমিক পরীক্ষাও এসে গেল। সেই পরীক্ষাতেও প্রথম বিভাগের নম্বর নিয়ে পাশ করল সে (২০১১ সালে)। এবারে উত্তমের সাহায্যে এগিয়ে এলেন কলকাতার খিদিরপুরের অনুভব ফাউন্ডেশন- এর শ্রীমতী সুমিত্রা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর আর্থিক সাহায্যে উত্তমের পড়াশোনা আবার শুরু হল। এবারে কোচবিহার রামভোলা হাই স্কুলে। একেবারে তলানিতে থাকা আর্থিক সঙ্গতি নিয়েও পড়াশোনা চালিয়ে যাবার মানসিক শক্তি তাকে জুগিয়েছেন শ্রীমতী চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু আবার চোখের সমস্যা শুরু হয়। আবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে বেশ কিছুদিনের জন্যে চিকিৎসা হয়। আবার একটা বছর নষ্ট হয়।
২০১৪ সালে সব প্রতিকূলতাকে সঙ্গে নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে উত্তম ৩৩৬ নম্বর পেয়ে। এবারে কলেজে ভর্তি হবে সে।
Leave a Reply