১০ আগস্ট, জিতেন নন্দী#
প্রতিবছর ঈদের দিনটায় আমার সবচেয়ে ভালো লাগে সকালবেলায় নামাজের পর সাদা পোশাক পরা দলে দলে মানুষ দেখতে। আজকাল অবশ্য অনেককে রঙিন পোশাকও পরতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্যাটক্যাটে গাঢ় রঙের ধুতি ইত্যাদি পরা আর পাঞ্জাবির ওপরে গলায় একটা রঙচঙে গামছা — বিচ্ছিরি লাগে দেখতে।
আজ ঈদের পরদিন দুপুরবেলায় সন্তোষপুর স্টেশনে গিয়েছিলাম ট্রেন ধরতে। কত ছেলেমেয়ে পথে বেরিয়ে পড়েছে আনন্দ করতে। সকলের পরনে নতুন পাটভাঙা পোশাক। চারদিক থেকে মাইকের আওয়াজ ভেসে আসছে। একটাও গানের কলি বোঝা যাচ্ছে না বটে, তবে জমাটি মিউজিকটা শুনতে অসুবিধা হচ্ছে না। প্ল্যাটফর্মের ওপর এমনিতেই সারি সারি দোকান, একটা পুরোদস্তুর বাজার। ঈদের আগে আরও কয়েক ডজন দোকান খোলা হয়েছে। তবে দুপুরবেলায় অনেক দোকানই ফাঁকা। কদিন দিনরাত বিক্রিবাটা হয়েছে। এখন সকলেরই বিশ্রাম আর পরবের আনন্দ করার সময়।
২নং প্ল্যাটফর্মে একটা দোকানে ছোট্ট একটা ছেলে লাচ্ছা বিক্রি করছে। পিছনে মশারি খাটিয়ে দোকানদার ঘুমে কাদা। আমার পরিচিত শহীদুলের পাত্তা নেই, ওর দোকানের চৌকিটা তুলে দাঁড় করানো আছে। কদমগাছের তলায় যে মহিলা পেয়ারা বিক্রি করেন, অন্যদিন ডালায় থাকে বিশ–পঞ্চাশটা পেয়ারা। আজ ডালার পাশে একটা বড়ো ঝুরি বোঝাই পেয়ারা। মহিলা হাঁকছেন, তিনটাকা–চারটাকা, দশটাকায় চারটে। কেউ ডালা থেকে পেয়ারা বেছে নিয়ে কিনলেই মহিলা সেটা চার টুকরো করে কেটে একটু ঝাল–নুন লাগিয়ে ক্রেতার হাতে তুলে দিচ্ছেন। মহিলাকে দেখলে বয়স বোঝা যায় না, রোগা শক্ত–সমর্থ চেহারা। একবার একটা মাঝবয়সি লোক পেয়ারা কিনে তাঁকে প্রেম নিবেদন করতে গিয়েছিলেন। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখছি। কী গো তোমার ঘরে কে কে আছে? কোথায় ঘর? এইসব খেজুরে আলাপে মহিলা শুকনো গলায় জানালেন, ওঁর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তার বাচ্চাকাচ্চাও আছে। লোকটা একটু দমে গেলেন। আর এগোলেন না। একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলের জন্য ওর বাবা পেয়ারা কিনে মায়ের হাতে দিলেন। ওর মা পেয়ারার একটা টুকরো বাচ্চাটার হাতে তুলে দিলেন, সেটা পড়ে গেল। আর একটা দিলেন, সেটাও হাত ফস্কে পড়ে গেল। তৃতীয় টুকরোটাও পড়ে গেল। বাবা রীতিমতো মায়ের ওপর বিরক্ত। অবশেষে শেষ টুকরোটা হাতে ধরে বাচ্চাটা মুখে দিল, মায়ের স্বস্তি!
সব ট্রেনই আজ লেটে চলছে। মাঝে একটা মালগাড়ি চলে গেল। দূরে মালগাড়িটা আসছে আর এক–একটা ছেলে লাইন টপকে প্ল্যাটফর্মে উঠছে। ট্রেনটা একেবারে সামনে চলে এসেছে, তখনও কেউ কেউ ১নং প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনলাফে ২নং প্ল্যাটফর্মে উঠে পড়ছে। ওদের বাহাদুরিকে মোটেই তারিফ করতে পারি না, বরং বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে।
এরই মধ্যে একজন স্বামী–স্ত্রী তাদের তিন ছেলেকে নিয়ে আসছে। মা একটা ছেলেকে একটা ঝাপ্পড় দিলেন। বাপটাও কষিয়ে আর এক ঝাপ্পড় — আমি আটকাতে যাই, ‘কী করেন, পরবের দিনে কেউ বাচ্চাকে মারে?’ বাচ্চাটা অবশ্য নির্বিকার, নিজের আনন্দে মশগুল। বাঁ হাতের কব্জিতে একটা খেলনার ঘড়ির ব্যান্ড আটকাতে সে তখন ব্যস্ত!
ট্রেন স্টেশনে ঢোকে। ভিড়ে ঠাসা প্রত্যেকটা কামরা। বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েরা চলেছে ঈদের খুশিতে আনন্দ করতে করতে। উঠতি বয়সের ছেলেরা উল্লাসে ফেটে পড়ছে। কতগুলো মেয়ে দারুণ সেজেছে, চারপাশে যা দেখছে তাতেই তারা হেসে গড়িয়ে পড়ছে। তবে প্রত্যেকে অপরকে ধরে আছে, পাছে কেউ দলছুট না হয়ে পড়ে।
ফেরার পথে সন্ধ্যায় আরও ভিড়। নিত্যযাত্রীরাও আছে। লেক গার্ডেন্স স্টেশনে উঠল ‘মহাশক্তি তেল, করে নাকো ফেল’। উঠেই আমাদের পরিচিত তেল–মলম বিক্রেতা পেটেন্ট ডায়ালগ শুরু করে দিলেন। একটা বাচ্চা ছেলেকে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে বাবু, কোথায় গিয়েছিলি?’ — নিকো পার্ক। আমি জিজ্ঞেস করলাম ওকে — নিকো পার্কে কত টিকিট? ও জানে না। সামনের সিটে ওর চেয়ে একটু বড়ো একটা বাচ্চা ছেলেকে বলল, ‘দাদু নিকো পার্কে যাবে, টিকিটের দাম বলে দে’। নিকো পার্কে ঢুকতে লাগে একশো টাকা। সায়েন্স সিটিতে ত্রিশ টাকা। তবে নিকো পার্কে ভালো করে ঘুরতে নাকি দু–তিনহাজার টাকা খরচ। ওরা সকালে বেরিয়ে নিকো পার্ক, সায়েন্স সিটি ঘুরে ফিরছে।
পরবের বাঁধ ভাঙা আনন্দ দেখতে ভালোই লাগে। ফেরার পথে শিয়ালদা স্টেশনে দেখছি রজনীগন্ধার চারা বিক্রি হচ্ছে, দশটাকা গোছা। কেউ কেউ তা হাসি মুখে কিনে নিচ্ছে, পরবের এই একটু ফুরসত, এই বর্ষায় চারাগুলো ঘরের পাশে লাগিয়ে দিলে সাদা রজনীগন্ধা ফুটে উঠবে। তাতেও আনন্দ।
তবে উঠতি বয়সের ছেলেরা যখন রাস্তায় হুঙ্কার দিতে দিতে মোটরবাইকে হ্যান্ডেল ছেড়ে দিয়ে হাত ওপরে তুলে ঝড়ের মতো পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়, খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে উঠি। এতখানি বাঁধ ভাঙা আনন্দ সইতে পারি না, শিউরে উঠি ভয়ে।
Leave a Reply