মণীষা গোস্বামী, কোচবিহার, ৪ জুলাই#
তখন আমার বয়েস ৫ কি ৬ বাবার হাত ধরে রাসের মেলায় গিয়েছিলাম। তখন যা বয়েস যা দেখি তাই ভালো লাগে। তার মধ্যেই দেখলাম মেলার মাঠের পাশের রাস্তার ধারে বসে একটা লোক কি সব জিনিস দিয়ে কাগজে আঁকিবুঁকি কাটছে। কৌতুহল হল – ঐগুলো কি? কাছে গিয়ে দেখলাম লোকটা একটা বড় গোল চাকতি কাগজের উপর বসিয়ে তার ভেতরে আবার একটা ছোট চাকতি বসিয়ে তার মধ্যে দিয়ে লাল, নীল, সবুজ পেন চালাচ্ছে আর তাতেই কাগজে হরেকরকম নক্সা ফুটে উঠছে। বাবা কাছে চাইতেই পেয়ে গেলাম। তখন দাম ছিল ৫ টাকা। বাড়ি আনার পর বহু চেষ্টাতেও কাগজে নক্সা হল না, কাগজ ছিঁড়ে গেল। তার পরের বছর আবারও কিনলাম, কিন্তু কিছুতেই নক্সা হয় না। এরপরও কয়েকবার কিনেছি কিন্তু কোনওদিনই নক্সা করতে পারিনি। তখন মনে হত লোকটার চাকতিটাই বুঝি ভালো বাকিগুলো খারাপ। এরপর পেরিয়ে গিয়েছে অনেকদিন, আমার বিয়েও হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যেই বরের সাথে রথের মেলার মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে আবার চোখে পরল সেই চাকতির নক্সা। পুরোন স্মৃতি মনে পরে গেল, কিনেও ফেললাম। এখন দাম বেড়ে ২০ টাকা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার জায়গা সেই রাস্তার ধারেই রয়ে গিয়েছে। কিনলাম ঠিকই, কিন্তু করতে পারব তো? বাড়ি এসেই বসে গেলাম, যথারীতি একরাশ কাগজ ছিঁড়ে যাবার পরও কিছুই হল না। বর ঘরে ঢুকে আমার কান্ড দেখে হতবাক। আমার হাত থেকে নিয়ে নিমেষের মধ্যেই কয়েকটা নক্সা করে ফেলল। তার মানে এটার মধ্যে কোনও কায়দা আছে। শিখে নিলাম ব্যাপারটা। ২০ বছর পর আমার হাত দিয়েও তৈরি হল সেই নক্সা। সাফল্যের আনন্দ সবসময়েই আলাদা রকমের।
পরদিন আবার গেলাম, আমার দিদির ছেলেকে একতা কিনে দিতেই হবে, আর আমিই দেখিয়ে দিতে পারব কিভাবে বানাতে হয়। জিনিসটা নেওয়ার পর লোকটার সাথে কিছু কথাও বলে ফেললাম ,এই শহরের দর্জিপাড়ায় থাকে সে। ছোট থেকেই এই ইন্ডিয়া গ্রাফ বিক্রি করে আসছে, তার বাবাও এই খেলনা বিক্রি করত, বাবার সাথে মেলায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতে করতে অন্য কিছু করার কথা ভাবেনি কখনও। বাড়িতে অসুস্থ মা আর ছোট ছেলে আছে, ছেলেকে তার সাথে কখনও আনেনা সে, চায় না তার ছেলে এই জিনিস বিক্রি করে ইনকাম করুক। মায়ের ওষুধ আর ছেলের পড়াশোনার খরচ যোগার করতে নাজেহাল অবস্থা – বিক্রি নেই যে তেমন। সবসময়ে মেলায়-মেলায় বা হাটে ঘোরার জন্যে বাড়িতেও থাকা হয় না অনেক সময়েই। অন্য দু-একটা ব্যবসা চেষ্টা করেছিল কিন্তু চলেনি, তাছাড়া মনও টানেনা। কখনও রোজগার এত কমে যায় যে দুবেলা ঠিকমত খাবার জোটেনা, কিন্তু মায়ের ওষুধের জন্যে কিছু টাকা রাখতেই হয়। মেলায় মেলায় ঘুরলেও ছেলেটার জন্যে মেলা থেকে কোন ভালো খেলনা নিয়ে যেতে পারেনা একবারও। মনটা খারাপ হয়ে গেল, আমার মত আরো কত না মানুষকে অন্তত কিছু সময়ের জন্যে আনন্দ দেবার উপকরন সরবরাহ করা মানুষটার জীবন এত দুঃখে ভরা কেন? বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হল এত কিছু জানা হল, লোকটার নামটাই জানা হল না।
Leave a Reply