অমিতাভ সেন, কলকাতা, ২৬ সেপ্টেম্বর#
বেড়াতে গেছিলাম টাকীতে। ইছামতীর ধারে এই পুরোনো শহরটা বেশ সুন্দর। হাসনাবাদের ট্রেনে চেপে টাকী রোড স্টেশনে নেমেই মন ভালো হয়ে গেল। কলকাতার হইচই যেটুকু ট্রেনের ইঞ্জিনের আওয়াজ বয়ে এনেছিল, ট্রেন চলে যেতেই তার সব শেষ। ছিমছাম স্টেশনটা এত চুপচাপ যে লাইনের ওপারে ধানখেতের পাশে খেজুরগাছের ডালে পাখি নড়ার সরসর শব্দ এপারের প্ল্যাটফর্ম থেকে শোনা যাচ্ছে। ওই দেখো পাখি, ওটা কী পাখি — আমাদের চেঁচামেচিতে হলুদ দুটো ডানা মেলে উড়ে গেল পাখিটা — হলুদ বসন্ত।
স্টেশন থেকে ভ্যানে করে নদীর ধারের গেস্ট হাউসে যেতে হবে শহরের অন্য প্রান্তে। যেতে যেতে দেখলাম টাকী শহরের স্কুল-কলেজ, রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি সবই বেশ পরিচ্ছন্ন। ভাদ্রের ভরাপুকুরে শালুক ফুটে রয়েছে চৌমাথার মোড়ে — কোনো মন্ত্রীসান্ত্রীর নির্দেশে নয়, শরতের নির্দেশে। এলা রঙের একতলা বাড়ির পাশ দিয়ে বাঁক নেওয়ার সময়ে নাকে এল মিষ্টি ফুলের গন্ধ। সাদা ছোটো ফুল এক ঝলকে অদৃশ্য হওয়ার সাথে সাথে যাত্রীদের মধ্যে বিতর্ক তুলে দিল — জুঁই না হাসনুহানা? মফস্বল শহরে গ্রাম ও নগর দুই-ই পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে চলেছে। পাঁচিলের গায়ে একটানা বিজ্ঞাপনে লেখা আছে — কোথায় ভালো ফার্নিচার পাওয়া যাবে, হনিমুনের জন্য কোথায় যাওয়া ভালো, মাতৃসদনের ঠিকানা আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের হদিশ। এমনভাবে পরপর সাজানো — দেখে বেশ মজা লাগল, মনে হল, মধ্যবিত্ত জীবনের প্রবাহকে একটা ধারাবাহিকতায় তুলে ধরতেই যেন এইসব লেখা।
ইছামতী নদীর ধারে সরকারি-বেসরকারি অনেকগুলো গেস্ট হাউস আছে। সেখানে কোথায় ঢুকলে দুপুরবেলায় বেজায় খারাপ রান্নাও স্বাদ মারতে পারে না এমন দারুণ ইলিশ পাওয়া যায় এবং সারাদিন ঘরে বসে নদীর ওপারে বাংলাদেশের আবছা গাছপালা আর এপারে ইন্ডিয়ার ফ্ল্যাগ তোলা জেলে নৌকার ঘোরাফেরা দেখে রাতে তাজা চিংড়ির লাল রসা খাওয়া যায়, তার ঠিকানা না দিলেও পেয়ে যাবেন। কারণ ও জায়গাটাই অমনি, অবিশ্যি যদি পকেট ভারি থাকে — তখন সেসব, ওখানে যে সারাক্ষণ নদীর ঢেউয়ের ছলাৎছল আর সারাক্ষণ উড়ালি-বিড়ালি বাও তেমনই স্বাভাবিক, যেমন স্বাভাবিক সীমান্ত এলাকা বলে বগলে বন্দুক উঁচিয়ে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের আনাগোনা, নদীর ধার বরাবর কিছুটা অন্তর ওয়াচ টাওয়ার আর ঝকঝকে স্পীডবোটের ধারালো হেডলাইট।
টাকীতে ঘুরে দেখার জিনিস কী কী আছে পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই জেনে যাবেন – ভ্যানওয়ালারাই বলবে ‘বাবু, ঘুরতে হলে বলবেন, রাজবাড়ি, নন্দদুলাল মন্দির, গোলপাতার জঙ্গল মিনিসুন্দরবন সব দেখিয়ে দেব ভালো করে।’ তারপর মালপত্র নামিয়ে ঘাটের ধারে দাঁড়িয়ে চা খেতে গেলেই মাঝির ছেলের চিকন গলা শোনা যাবে ‘ভুটভুটিতে যাবেন — রাজবাড়ি, পিকনিক স্পট, বিএসএফ ক্যাম্প, মাছরাঙ্গা দ্বীপ দেখবে’। ঠিক সেই সময় চার-পাঁচজন গামছাওয়ালা এসে নানা সাইজের গামছা মেলে ধরে বসিরহাটের গামছা বলে বাজারের তুলনায় বেশ কম দাম চাইবে। আপনারাও কেউ কেউ দু-একটা কিনে ফেলবেন- শুধু সস্তা বলে নয়, স্থানীয় হস্তশিল্পকে বাঁচানোর তাগিদেও।
আমরা আটজনের দল ওইসব ভেবেই চারটে গামছা কিনে ফেলেছিলাম। তারপর যে দুদিন ছিলাম তার মধ্যে আরও বার চারেক রাস্তাঘাটে আরও হাফডজন গামছাওয়ালা অনেক পীড়াপীড়ি করেছিল। আমরা তাদের বোঝালাম, গামছা কেনা হয়ে গেছে, এবং শুধু গামছা পরলেই আমাদের চলবে না। সাথে সাথে বুঝলাম এখানকার এই অধিবাসীরা ট্যুরিস্টদের ওপর কতটা নির্ভরশীল।
ঘুরে দেখার যে জায়গাগুলোর কথা বললাম, সেগুলো আমরা দেখেছি একদিন বিকেলে ভুটভুটি নৌকায় চেপে চল্লিশ মিনিটের নৌকা ভ্রমণে। উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে বসে দূরে তীরের দিকে আঙ্গুল তুলে তুলে মাঝির ছেলে সবই দেখালো যা সে বলেছিল। আমরা তা দেখলাম আর তার চেয়েও ভালো দেখলাম ছেলেটার গাইড হওয়ার সম্ভাবনা। মোটরের প্রচণ্ড আওয়াজের মধ্যেই সে চেঁচিয়ে জানালো তার নাম বাপ্পা মণ্ডল। কোন ক্লাসে পড়ে জিজ্ঞেস করায় এক হাতের পাঁচ আঙ্গুল আরেক হাতের তর্জনী তুলে জানালো ছয় ক্লাস। ছুটির দিনে এইভাবে দশ-বিশ টাকা সে পেয়ে যায় ট্যুরিস্টবাবুদের কাছ থেকে। নদীর পেটের মধ্যে নৌকার খোলের ভেতরে বসে বাইরে কাঁধের উচ্চতায় জলের স্রোত বয়ে যেতে দেখে গা ছমছম করে। পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া মরা গরুর পেটফোলা লাশ, পারের বাঁধের ভাঙ্গা অংশে জলের খলখলানি গা শিরশির ভাবটা আরও বাড়িয়ে দেয়। অনেকটা উঁচু পারের ওপর কেয়ার ঝোপ আর ইঁটভাঁটার চিমনি আমাদেরকে ঘাটের পথ দেখিয়ে দেয়। সন্ধ্যের ঝোঁকে ঘাটে নেমে কিছুক্ষণ কারো মুখে কথা সরে না। বিকেলের ম্লান আলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে কেমন একটা বিষাদের আবহ তৈরি করে।
পরদিন সকালে গেছিলাম মিনি সুন্দরবন। নিয়ে গেল দেবদাস আর লাদেন। দেবদাস মানে দেবদাস মণ্ডল — দেবদাস বলে ওরা রাজবংশী জেলে। আর লাদেনের আসল নাম শাহিন। ওকে দেবদাস লাদেন বলে ডাকে। ১২-১৩ বছরের বাচ্চা ছেলে শাহিনকে ভ্যানওয়ালা থেকে ওখানকার দোকানদারেরা সকলেই লাদেন বলে ডাকে, ও তাতেই হাসিমুখে সাড়া দেয়। কালো পাথরের মতো শক্ত চেহারার যুবক দেবদাস লাদেনকে স্নেহ করে। ওকে ডেকে নেয় আমাদের দুটো গাড়ি লাগবে বলে। গাড়ি চালাতে চালাতেই সে জানায়, ‘জানেন, লাদেনের চার চারটে দাদা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। তারপরে ও, ওর নিচে আর এক ভাই, আর বিধবা মা। মা বাইরের কাজ করতে পারে না। ও তাই পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে ভ্যান রিকশা চালাচ্ছে। ওর পয়সাতেই ওদের সংসারটা চলছে।’
আর তোমার সংসার? দেবদাস বলে, ‘আমার বউ, দুটো বাচ্চা। বড়ো মেয়ে থ্রিতে পড়ে টাকী গার্লস স্কুলে। ছোটো ছেলে ওয়ানে। নিজেদের পাঁচ বিঘে জমি ছিল। ধানি জমি। বোনের বিয়ে দিতে গিয়ে বাবাকে সে জমি বেচে দিতে হল। বাবার দোষ ছিল না। আমি তো ঠিক সুবিধের ছিলাম না। কম বয়সে খালি উড়ে বেড়াতাম। বাবা-মা ডাকলেও ঘরে যেতাম না। এখন ১১কাঠার ভিটে বাড়ি এই কাছেই। ছোটো ভাইটা এমব্রয়ডারির কাজ করে, ওর রোজগারপাতি খারাপ না। আমি তো এই ভ্যান চালাচ্ছি। মাথা পিছু ৪০ টাকা করে আপনাদের এই ৪ জন সওয়ারির থেকে ১৬০ টাকা, আরও দু-একটা স্টেশনে যাওয়ার ভাড়া পেলে ২০০/২৫০ টাকা হবে। অফ সিজনে এর বেশি হয় না। পুজোর থেকে সিজন শুরু হবে। চলবে শীতকাল পর্যন্ত। তখন এরকম ট্যুরিস্ট ট্রিপ পাওয়া যায় অনেক — কিন্তু তিন-চারটের বেশি টানা যায় না। দেখছেন তো কতটা রাস্তা।’ দেখলাম সত্যিই খুব খাটনির কাজ। যাতায়াতে প্রায় পৌনে ২ ঘন্টা ভ্যানগাড়ি চলেছে।
পথে দেখেছি প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো নন্দদুলালের মন্দির। মন্দিরের সামনে খোলা মাঠের ঘাসে নীল তারার মতো ছোটো ফুল, বিরাট পুকুরের ওপর উড়ে যাওয়া বক। গোলপাতার জঙ্গল বা মিনি-সুন্দরবন আমাদের মূল গন্তব্য, সেটা বাংলাদেশ সীমান্তের ধারে। ইটপাতা পথ সেখানে সিমেন্টে বাঁধাই হয়ে শ্বাসমূলওয়ালা গাছের জঙ্গল বেয়ে চলে গেছে এক বাঁধানো চত্বরে। উঁচু সেই পাকা পথের নিচে ইছামতীর মরা সোঁতায় জল নেই। থকথকে কাদায় চিতি কাঁকড়া আর অল্প জলে গুলে মাছ দেখা যায় নিচে। এতক্ষণ যে বসত এলাকার মধ্যে দিয়ে এলাম তা এখানে এসে শেষ হয়েছে। গোয়ালের ধারে রাংচিতা বা কুয়োর পাড়ে কালকাসুন্দির ঝোপের কাঁচা সবুজ এখানে এসে নোনা গাছের কালচে সবুজে পরিণত হয়েছে। জায়গাটা বেশ নির্জন — তবে মিনি-সুন্দরবন নামটা বোধহয় টুরিস্টদের আকর্ষণ করতেই। যারা সুন্দরবন দেখেছে তাদের অমনটাই মনে হবে।
এই যা দেখার। তাছাড়াও দেখলাম ওখানকার মানুষজন। বিকেলের টিফিন কিনতে গিয়ে দেখলাম দোকানে লেখা আছে ণ্ণইছামতী লস্যি খান এখানে পাওয়া যায়’। সে দোকান তখন বন্ধ ছিল। উল্টোদিকের দোকানে সিঙ্গাড়া কেনার সময় একজন খদ্দেরের সঙ্গে দোকানির কথোপকথন শোনা গেল। এসইউসি-র প্রচারক তখন সাইকেল রিকশায় চড়ে মাইকে ণ্ণমূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আগামী ২০শে সেপ্টেম্বর বন্ধ সফল করুন’ বলতে বলতে চলেছে। খদ্দেরটি গজগজ করছিল, ণ্ণকী হবে বন্ধ করে, জিনিসের দাম কমবে? দুগুণা, চারগুণা করে রোজ বেড়ে চলেছে।’ চেহারাটা তার খেটে খাওয়া মানুষের মতো। দোকানদার তাকে খুচরো ফেরত দিতে দিতেই বলল, ণ্ণএকটা প্রোটেস্ট তো হবে।’ খদ্দের অসম্মতির মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল।
পরের দিন সকালে আলাপ হল পুরসভার নির্মিত সুলভ-কমপ্লেক্সের শৌচাগারে যে ছেলেটা বসে তার সঙ্গে। একটাকা দিয়ে বাথরুম সেরে ফেরার সময় কথা হল। নাম বলল নিত্যানন্দ মণ্ডল। আঙ্গুল তুলে বাড়ি দেখালো একটু দূরে। বাইশ-চব্বিশ বছরের ছোকরা। সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা অবধি ডিউটি দেয় ওখানে। মধ্যে আধঘন্টা স্নান-খাওয়ার ছুটি। মাইনে কিছু নির্দিষ্ট করা নেই। শৌচাগার ব্যবহারকারীরা যে পয়সা দেয় সেটাই তার মাইনে। অফ সিজনে ৪০-৬০ টাকা হয়। সিজনে ২০০-২৫০ টাকা। বাথরুম পরিষ্কার করার দায়িত্ব নিজের খরচায়। তাতে কিন্তু ছেলেটার হাসির কমতি নেই। কথা বলতে বলতে সে মাঝে মাঝে হাসছিল।
আর আলাপ হল তিলক দাস ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে। ওঁরা দুজনে দোকান চালান নদীর ধারে। ণ্ণতোমার হিংসা আমার জয় ভ্যারাইটি স্টোর্স’ ওঁদের দোকানের নাম। ওখান থেকেই পান-সিগারেট-চা-সাবান কিনতাম আমরা। ফেরার দিন দুপুরের খাওয়া ওখানেই খেলাম। ডাল-ভাত-আলুর চোখা- কচি পটল দিয়ে জ্যান্ত পোনার ঝোল। সত্যি কী অপূর্ব খেতে! ৪০ টাকার এই ডিশ গেস্ট হাউসের ১২০-১৪০ টাকার দামি মাছের ডিশকে হারিয়ে দিল শুধু রান্নার গুণে। মুগ-মুসুরি মেশানো ডাল আমরা ভাতে মেখে খেলাম, চুমুক দিয়ে খেলাম, তবু রয়ে গেল। ভাতটা একটু মোটা চালের হলেও স্বাদটা বেশ মিষ্টি, তাও সব খেতে পারলাম না।
এমন সময় লাদেন এল। দেবদাস ওর জন্য অপেক্ষা করছিল আর দোকানের কাজে তিলকদা ও বৌদিকে সাহায্য করছিল। ওরা আজ আমাদের স্টেশনে নিয়ে যাবে আগেই বলে রেখেছিল। আমরা ফিরে যাচ্ছি কলকাতা। কানে এল দোকানদার-বৌদি বলছেন, এই লাদেন ভাতটা ডাল দিয়ে খেয়ে নে না। লাদেনেরও তখন খিদে পেয়েছে। সকালে সে ভ্যান নিয়ে স্টেশনে গিয়েছিল। সে হাত ধুয়ে ফেলল। তিলকদা বললেন, ওইটুকু ভাতে ওর খাওয়া হবে নাকি? দেবদাস বলল, আকাশের মেঘ দেখছিস, চেপে বৃষ্টি নামবে, আগে বাবুদের ছেড়ে দিয়ে আসি চল, ফিরে এসে খাস। বৌদি বলল, ঠিক আছে, তোর ভাত ঘরে রাখা থাকবে। ঘাড় একদিকে কাত করে লাদেন ভ্যানচালকের সিটে গিয়ে বসল। দেবদাস তার সামনের ভ্যানের সিটে। আমরা ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে উঠতে উঠতে শুনলাম তিলকদা আর বৌদি বলছেন, ণ্ণআবার আসবেন। আমাদের দুটো থাকার ঘরও আছে। থাকতে পারেন। বিজয়া দশমীর দিন খুব ভিড় হয়। আগে থেকে খবর দিলে ঘর পাবেন। ওইদিন এলে খুব মজা হয়, ওপার-এপার করতে কোনো বাধা থাকে না।’
আমরা ভাবতে ভাবতে ফিরলাম, বাধা থাকলেই বা কী? রক্ষী দিয়ে সীমানা সত্যি কতটা বাঁধা যায়? তিলকদা-বৌদি-দেবদাস-লাদেন সবাইকে তো একই পরিবারের মনে হয়। তাছাড়া, ইছামতীর জল কি সত্যিই ভাগ করা যায়? ওপারের জল এপারের সাথে মিশে যাচ্ছে না? একা ভূগোলের বিভাজনকেই ঠেকানো যায় না তার সঙ্গে যদি তার দোসর হিসেবে ইতিহাস এসে জোটে? ভাবতে ভাবতে বৃষ্টি এল, শিল্প-সাহিত্যে বিচ্ছেদের দৃশ্যে যেমনটা হয়, ঠিক তেমনটা, এই যাওয়ার সময় সত্যি! ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে স্টেশনে এসে ট্রেন ধরলাম ১২টা ৩-এর।
Leave a Reply