পশ্চিমঘাট পর্বতমালা এবং বনাঞ্চলের পরিবেশ বাঁচানোর স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রকের তলবের ভিত্তিতেই ২০১১ সালের আগস্ট মাসে ইকোলজিক্যাল এক্সপার্ট গ্রুপ একটি রিপোর্ট দেয়। সেই রিপোর্টকে কাটাছেঁড়া করার জন্য কস্তুরীরঙ্গনের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি করেছিল কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রক। কস্তুরীরঙ্গনের কমিটি আগের মাধব গ্যাডগিল কমিটির তৈরি করা রিপোর্ট নস্যাৎ করে দিয়ে যেটি বানিয়েছে, সেটি পশ্চিমঘাট বনাঞ্চলকে বাঁচাতে নয়, ধ্বংস করতে সাহায্য করবে। নিচে কস্তুরীরঙ্গনকে লেখা মাধব গ্যাডগিলের চিঠি। উল্লেখ্য, কেন্দ্রিয় সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে তারপর সেই কমিটির পরামর্শ না মেনে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেমতো বিধান দেওয়া চালু রেওয়াজে পরিণত করে ফেলেছে। সম্প্রতি দিল্লির ধর্ষণ কান্ডের পর একটি কমিটি তৈরি হয়েছিল যৌন হেনস্থা রোধে নয়া আইন তৈরির জন্য। সেই কমিটির রিপোর্ট না মেনেই আপাতত একটি আইন তৈরির চেষ্টা চলছে#
ডঃ কস্তুরিরঙ্গন মহাশয়
উনিশ শতকের সম্মানিত বিজ্ঞানী জে বি এস হ্যালডেন সুয়েজে ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে ওই দেশ ছেড়ে এসে ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন : বাস্তব কেবল আমাদের অনুমানের চেয়ে অজানাই নয়, বরং আমরা যতটা অনুমান করতে সক্ষম তার চেয়েও অজানা! আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে আপনারা ‘হাই লেভেল ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ওয়েস্টার্ন ঘাট’-এর মতো একটা রিপোর্টের অংশীদার হতে পারেন!
আমাদের ব্যাপক আলোচনা ও ক্ষেত্র-পরিদর্শনের ভিত্তিতে আমরা পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের কাছে একটা রিপোর্ট পেশ করেছিলাম, তাতে আমরা পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল পশ্চিমঘাটকে রক্ষা করার জন্য কয়েকটি ধাপে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছিলাম, যার মধ্যে তৃণমূল স্তরে কিছু জোগান দেওয়ার ভূমিকাই ছিল প্রধান। আপনারা এই কাঠামোটাকে বাতিল করেছেন এবং তার জায়গায় একটা ভাগাভাগির সুপারিশ করেছেন, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ — যাকে আপনারা বলেছেন প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য — রক্ষা করবে বন্দুক এবং পাহারাদারেরা; বাকি দুই-তৃতীয়াংশ হল তথাকথিত সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্য। সেটা ছেড়ে রাখা হবে উন্নয়নের জন্য, যেমনটা প্রসব করেছে গোয়ার ৩৫০০০ কোটি টাকার বেআইনি মাইনিং কেলেঙ্কারি। এর অর্থ হল পরিবেশ ধ্বংসের মরুভূমিতে বৈচিত্র্যের মরুদ্যানের রক্ষণাবেক্ষণ করা। বাস্তুতন্ত্র আমাদের শিখিয়েছে, এই ধরনের ভাগাভাগির ফলে অনতিবিলম্বে মরুদ্যানকে গ্রাস করবে মরুভূমি। যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, প্রাণী ও গাছপালার স্বাভাবিক আবাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং পরিবেশ ও সমাজ বান্ধব ছাঁচের ভাবনা যাতে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকাগুলির সংরক্ষণ সুনিশ্চিত হয় এবং এটাই আমরা প্রস্তাব করেছিলাম।
উপরন্তু, টাটকা জলের জীববৈচিত্র্য অরণ্যের জীববৈচিত্র্যের তুলনায় অনেক বেশি বিপন্ন এবং সেটা রয়েছে মূলত আপনাদের ভাষায় সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যের মধ্যে। টাটকা জলের জীববৈচিত্র্য আমাদের জনসমাজের বৃহৎ অংশের জীবিকা ও পুষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণে আমরা মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরি জেলায় লোটে কেমিকাল ইন্ডাস্ট্রি কমপ্লেক্সের বিশদ নমুনা সমীক্ষা উপস্থাপন করেছি। সেখানে দূষণের মাত্রা সমস্ত আইনি সীমা অতিক্রম করে ফিশারিগুলিকে ধ্বংস করেছে, যার ফলে ২০,০০০ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, মাত্র ১১,০০০ মানুষ শিল্পে কর্মসংস্থান পেয়েছে। তথাপি সরকার সেই এলাকায় ফের দূষণকারী শিল্প স্থাপন করতে চাইছে। অতএব সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের ‘জোনাল অ্যাটলাস ফর সিটিং অব ইন্ডাস্ট্রিজ’-কে চেপে যেতে চাইছে।
আমরা মর্মাহত যে আপনাদের রিপোর্ট আমাদের সংবিধান-রক্ষিত সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতার গণতান্ত্রিক হস্তান্তরকে নাকচ করতে চাইছে এই বলে যে, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় সমাজের কোনো ভূমিকা নেই। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, আপনাদের রিপোর্ট আমাদের রিপোর্টে পেশ করা তথ্যকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। অথচ সরকার লোটের বেআইনি দূষণের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, পুলিশের ক্ষমতার জোরে ২০০৭-০৯ সালে ৬০০ দিনের মধ্যে প্রায় ১৮০ দিনের সম্পূর্ণ ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে দমন করেছে।
ভারতের সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্য বহু মূল্যবান জীববৈচিত্র্যের উপাদান হাজির করেছে। পশ্চিমঘাটে আবদ্ধ লায়ন-টেইল্ড ম্যাকাক্ নামক বানর প্রজাতির পুরো ৭৫% চাবাগানের সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যে বেড়ে উঠেছে। আমি পুনে শহরে বাস করি। আমার এলাকায় বহু অশত্থ-বট, পিপল ও গুলার গাছ ছড়িয়ে রয়েছে; জেনাস ফিকাস প্রজাতির এই গাছগুলির মর্যাদা আধুনিক বাস্তুতন্ত্রে এক মূল উৎস হিসেবে, যা অন্য প্রজাতির বিপুল বৈচিত্র্যকে রক্ষা করে। সারা রাত আমি ময়ূরের ডাক শুনতে পাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি রাস্তায় গেলে দেখতে পাই, ওরা নাচছে। আমাদের দেশের মানুষ, ভারতের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে যাদের শেকড় রয়েছে, তারা প্রকৃতিকে সম্মান করে। তারা পবিত্র বৃক্ষ, ফিকাস প্রজাতির গাছ, বানর ও ময়ূরকে শ্রদ্ধা করে এবং রক্ষা করে।
আপাতভাবে এসব কিছুকেই ছেঁটে ফেলা হবে। এটা আমায় ফ্রান্সিস বুচাননের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এই ঘোষিত প্রতিনিধি ১৮০১ সালে লিখেছিলেন, ভারতের পবিত্র বৃক্ষগুলি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পত্তির অধিকারের দাবিকে আটকানোর ফন্দি ছাড়া কিছু নয়।
আজ মনে হচ্ছে, আমরা এখন ব্রিটিশের চেয়েও বেশি ব্রিটিশ এবং আমরা বলতে চাইছি যে আমাদের সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যের প্রতি একটা প্রকৃতি-বান্ধব দৃষ্টি কেবল দেশের ধনী ও ক্ষমতাবানদের এবং বিশ্বায়িত পৃথিবীর সমস্ত জমি ও জলকে দখল করে নিয়মহীন, কর্মহীন অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে কায়েম করে নিজেদের ইচ্ছে মতো শোষণ ও দূষিত করা আটকানোর ফন্দি ছাড়া কিছুই নয়। আমরা বিস্মিত যে আপনাদের রিপোর্ট সেই মনোভাবকেই কঠোরভাবে সম্মতি দিচ্ছে। সত্যিই বাস্তব আমাদের ধারণার চেয়ে বেশি অজানা!
মাধব গ্যাডগিল
Leave a Reply