রিখিয়া রায়, কলকাতা, ৩০ মে#
আমার এক বোন ব্যারাকপুরের ছোট্ট একটা মেয়েদের ইশকুলে পড়ে। ছাত্রী ভালোই। ব্যারাকপুর চলে যাওয়ার আগে ও বছর দুয়েক কলকাতার ইউনাইটেড মিশনারি স্কুলে পড়েছিল। আজ গল্প করতে করতে বলল ওর মতে ইউনাইটেড মিশনারি তো বেশ নামিদামি স্কুল কারণ টেস্ট পেপারে ওই স্কুলের প্রশ্নপত্র ছাপা হয়। ওর এই স্কুলটা ততটা ‘বড়ো’ নয়। অথচ ও জানে না, বাংলা মিডিয়াম স্কুল হওয়ার ফলে (একটা বড়ো কারণ) কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্তেরা এখন আর ইউনাইটেড মিশনারিকে ‘ভালো স্কুল’ বলে না।
একটা ইংরেজি ঈশপের গল্পের বই, যেটা আমি ইশকুলে দ্বিতীয় শ্রেণির বাচ্চাদের পড়াই সেইটা, হাতে নিয়ে ও পাতা উলটে পড়তে লাগল। দশম শ্রেণির এই ছাত্রী তারপর বলল যে ও এই বইগুলো এখন নিজে নিজেই পড়ে মানে বুঝতে পারে। কিন্তু ওর ইংরেজি মাধ্যমে পড়া বন্ধুর দেওয়া বই ‘ফেমাস ফাইভ’ পড়তে গেলে ডিকশনারি নিয়ে বসতে হয়। আমার কানে কথাটা বেশ বাজল। কারণ আমি নিজে ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছি। ক্লাস ফাইভে লুকিয়ে লুকিয়ে ‘ফেমাস ফাইভ’ পড়তাম কারণ ডিটেকটিভ বই পড়ছি দেখলে বাবা রাগ করত।
এই তফাত বড্ড অসুবিধেজনকভাবে বোন আর ওর বন্ধুর মধ্যে একটা অবাঞ্ছিত দূরত্ব তৈরি করেছে। ‘ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা কেমন হয় আর বাংলা মাধ্যমের ছাত্রেরা কেমন হয় এই নিয়েও প্রচুর কথাবার্তা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা স্তর পর্যন্ত হয়ে থাকে। এবং এই দুই মাধ্যমের ছাত্রেরা পরস্পরের সঙ্গে মিশতে সহজ বোধ করে না। এই তফাতগুলো আকাশ থেকে পড়েনি এবং সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আমাদের দেশে অন্য কোনো ভাষার এইভাবে এক লহমায় দূরের মানুষ করে দেওয়ার ক্ষমতা নেই।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াই আমি, তাই ট্রেনিং নিতে হচ্ছে। সারা সন্ধ্যে বসে বসে ভারতবর্ষে ‘প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা’ নিয়ে প্রবন্ধ লিখছিলাম। উইকিপিডিয়াতে তথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখলাম ২০০৫ সালের একটি রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে যে ভারতবর্ষের মাত্র ৩ শতাংশ মহিলা ও ৫ শতাংশ পুরুষ ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। বহু ভাষাভাষীর দেশে একটা সর্বজনগ্রাহ্য ভাষার প্রয়োজন রয়েছে এই কথা যদি মেনেও নেওয়া হয় তাহলেও তা কেন ইংরেজি এবং অন্য কোনো ভাষা নয় তার কোনো সদুত্তর নেই। অথচ স্বাভাবিক ভাবেই ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষ ইংরেজ শাসনের এত বছর বাদেও এবং ইংরেজি ভাষার আধিপত্যকে ধারণ করার পরেও দেশজ ভাষায় বেশি স্বচ্ছন্দ। হিন্দি যত সহজে আমার বোন শিখতে পেরেছে, ইংরেজি পারেনি। মাতৃভাষার সঙ্গে ভাষাগত মিল না থাকা এর একটা কারণ হতে পারে। গুটিকয়েক লোক যে ভাষা বলতে পারে তা অন্য লোকেদের ঘাড়ে চাপানোর কোনো অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার নয়, অথচ তা হয়েই চলেছে। এবং এই বিশেষ ভাষাটার নির্লজ্জ আধিপত্য বিস্তার এতটাই যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস বিভাগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ইংরেজিতে ৭০ শতাংশ নম্বর না থাকলে কোনো ছাত্র প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে পারবে না। ইংরেজি এখন আমাদেরই ভাষা হয়ে গেছে- এর মতো ভুল ভাবনা আর কিছু নেই। ইংরেজি আমাদের ভাষা হয়ে ওঠেনি এখনো, হয়ে ওঠাও বেশ দুষ্কর। আর তার আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তাও ভেবে দেখার মতো।
Leave a Reply