জিতেন নন্দী, ২২ জুন#
‘স্বাস্থ্য পরিষেবার অযৌক্তিকতা’ শীর্ষক আলোচনার প্রথম অংশে ডাঃ পীযূষ কান্তি সরকার এবং স্থবির দাশগুপ্তের অভিজ্ঞতার বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে আমরা প্রথমে ডাঃ শুভাশিস মিত্রের অভিজ্ঞতার কথা দিয়ে শুরু করছি। তিনি হাওড়ার ফুলেশ্বরে ‘সঞ্জীবনী সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল’-এর দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি ১৭ বছর বিদেশে কাজ করার পর দেশে ফিরে এই কাজে যুক্ত হয়েছেন। এতক্ষণের আলোচনায় প্রযুক্তি বিরোধী একটা ঝোঁক দেখতে পেয়েছেন বলে তাঁর মনে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি টেকনোলজির পক্ষে। আজকের দিনে প্রযুক্তির যে সাফল্য ও ব্যর্থতা, যে উন্নতি ও সীমাবদ্ধতা, তাই নিয়েই টেকনোলজিকে ব্যবহার করতে হবে। আমি তাকে অস্বীকার করতে পারি না। তার মধ্যে আমার অনেক জানা থাকবে আর অনেক অজানা থাকবে। সেটা বিজ্ঞানের প্রতিটা ক্ষেত্রেই সত্যি। চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে সেটা আরও সত্যি। … সঞ্জীবনী হাসপাতালে অনেক ডাক্তারদের সম্মিলিত প্রজ্ঞা এবং তা আমাদের দেশে কীভাবে প্রযুক্ত হবে, এইভাবে এগোনো হয়। … প্রতিদিন জ্ঞানের যে অগ্রগতি হচ্ছে, কখনো এগোচ্ছে কখনো পিছোচ্ছে, সরলরেখায় তো চলে না, কিছু জানা কখনো পরিষ্কার হয়, কিছু জানা থেকে ফিরে যেতে হয়, এটা প্রতিদিন আমাকে চর্চা করতে হয়, তার নাম ধারাবাহিক চিকিৎসা শিক্ষা।’
প্রযুক্তির পক্ষে বলতে বলতেই তিনি কবুল করেন, ‘আমাদের ধারাবাহিক চিকিৎসা শিক্ষা মানে হল সন্ধ্যাবেলায় তাজবেঙ্গলে গিয়ে মদ খাওয়া।’ দৃষ্টান্ত হিসেবে আসে, ‘এই যে অ্যান্টিবায়োটিকের এরকম ব্যবহার, এটা ভারতবর্ষে বহুল প্রচলিত। কারণ এখানে ডাক্তার নয়, ফার্মা কোম্পানি অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার ঠিক করে। …
এটা সমাজের সামগ্রিক অবক্ষয়ের একটা অঙ্গ। আগে ডাক্তারদের মধ্যে ছিল, আমরা স্ল্যাং ভাষায় বলতাম, ওই লোকটা জালি। এখন ব্যাপারটা সেরকম নয়। … আজকের কোম্পানি বলছে যে তুমি যদি চারটে স্টেন্ট (হার্টের অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির ক্ষেত্রে) দাও, তোমার বাড়িতে তিন হাজার টাকা পৌঁছে যাবে। এটা কিন্তু ব্যতিক্রম নয়, এটাই নিয়ম। একটা ব্লাড সুগারের দাম আশি টাকা। এর মধ্যে ল্যাব কত টাকা পায়? আর কাটমানি কত টাকা? ৬৫ টাকা কাটমানি আর ১৫ টাকা ল্যাব পায়।’
শুভাশিস মিত্র উপস্থিত চিকিৎসক বক্তাদের মধ্যে তুলনায় বয়সে নবীন। তবে তিনিও সত্তর-আশির দশকের চিকিৎসক আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই কাজ শুরু করেছিলেন। আজ তিনিও সঞ্জীবনী সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন, ‘আমাদের চারপাশে দুটো মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, এদিকে হুগলি, বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কোথাও সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল নেই। … যথাসম্ভব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে … আমরা অ্যাঞ্জিওগ্রাম করতে সাড়ে ছ-হাজার টাকা নিই, অন্যান্য হাসপাতাল কুড়ি হাজার টাকা নেয়। আমরা এক ভয়ঙ্কর আক্রমণের মধ্যে পড়েছি। গোটা মেদিনীপুর এবং হাওড়া, গ্রামীণ ডাক্তার কোয়াক ডাক্তারদের ট্রেনিং দেওয়া দরকার, আমি স্যারের (ডাঃ পীযূষ কান্তি সরকারের) সঙ্গে একমত। তবে আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা আলাদা। আজকের দিনে গ্রামে হাজার হাজার কোয়াক ডাক্তার। তারা এই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর ডিরেক্ট এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। কিছু কিছু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এমবিবিএস ডাক্তারদের থেকে তাদের কাছে বেশি বেশি যাচ্ছে। কারণ এমবিবিএস ডাক্তার যদিও বা দৈত্যকূলে প্রহ্লাদের মতো প্রশ্ন করতে পারে, কোয়াক ডাক্তার সেটা করবে না। … অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ঠিক করে যে একজন ক্রিটিকাল পেশেন্ট কোথায় যাবে। একটা বিলে ২০% এই ড্রাইভাররা ডিমান্ড করে। আমরা প্রথম দেড় বছর কোনো কমিশন দিইনি। এর ফল হয়েছে চারটে জেলা জুড়ে সঞ্জীবনী হাসপাতালকে টোটাল বয়কট করে দেওয়া। কোনো পেশেন্ট পার্টি যদি বলে সঞ্জীবনী হাসপাতালে নিয়ে যাও। সারা রাস্তা সঞ্জীবনী হাসপাতালকে গালাগাল করতে করতে যাবে। … এমনকী রিকশাওয়ালারাও রোগীকে পৌঁছে দিলে নার্সিং হোমের কাছ থেকে দুশো টাকা করে পায়।
চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পূর্ণ কর্পোরেট এবং পণ্য ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন। কোম্পানি তার প্রডাক্টের চাহিদা তৈরি করে দিচ্ছে, কেবল রোগীর মনে নয়, চিকিৎসকের মনে। ডাক্তার বলছে যে এই ওষুধটা কাজ করে না। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি অ্যাবসলিউটলি ক্রিটিকাল পেশেন্ট। খুব দ্রুত রিকভারি হওয়া দরকার। যে চিকিৎসক দায়িত্বে রয়েছে, সে ঠিক করে দিচ্ছে কোন ব্রান্ডের অ্যান্টিবায়োটিক ভালো কাজ করছে! একই জেনেরিক অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না! এইবার আপনি বুঝতেই পারছেন না, সে সত্যি সত্যি বলছে, না সেই ওষুধের কোম্পানি রাত্রিবেলা ডাক্তারের বাড়িতে খাম পৌঁছে দিচ্ছে! এই অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারদের প্রতি মাসে অন্য হাসপাতালগুলো পাঁচহাজার টাকা করে দেয় যাতে সঞ্জীবনীতে পেশেন্ট না নিয়ে আসে। সাধারণ মানুষের কাছে আধুনিক চিকিৎসা একটা মিথ, এই মিথটা তৈরি করে দিয়েছে কোম্পানিগুলো।’
‘তাহলে বুঝুন, মানুষের মধ্যে যৌক্তিকতা নেই। মানুষের চিন্তার মধ্যে যৌক্তিকতা নেই।… বর্তমান আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা অমানবিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। চিকিৎসকের প্রাথমিক দায়িত্ব থেকে সরে গেছে চিকিৎসা ব্যবস্থা।’ এইভাবে নিজের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করেন শুভাশিস মিত্র। তবু একই সঙ্গে তাঁর মনে হয় প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে সুপার স্পেশালিটি চিকিৎসা এবং সাধারণ মানুষের একটা ফোরাম আজ হওয়া খুব জরুরি।
এরপরে কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালের নিউরোসার্জন আশিস ভট্টাচার্য বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যে নিজের মূল্যবান অভিজ্ঞতার কথা ছিল। কিন্তু আলোচ্য বিষয়টা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছিল, তার সঙ্গে কথোপকথনে সেভাবে তিনি যোগদান করেননি। পরবর্তী বক্তা ছিলেন ছত্তিশগড় শহিদ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডাঃ শৈবাল জানা। ১৯৭৯ সালে সেখানকার শ্রমজীবী পরিবারের মহিলাদের প্রসূতি বিষয়ক সমস্যা নিয়ে ওখানে কাজ শুরু হয়েছিল। ১৯৮১ সালে একটা কমিটি তৈরি হয় এবং তারপর থেকে চলছে এই হাসপাতাল। পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসক আন্দোলনের একটা ঢেউ সেখানে পৌঁছেছিল। সেখানকার শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ শুরু করছিলেন সামান্য কয়েকজন চিকিৎসক। ফলে যৌক্তিক ও আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ সম্পূর্ণত নেওয়া যায়নি। শৈবাল জানা বলেন যে একটা নীতির ভিত্তিতে এবং অনেকটা লোক-জ্ঞানের (people’s knowledge ) ওপর নির্ভর করে চিকিৎসার কাজ এগিয়েছে। এখনও ওখানে পাঁচ টাকা বেড চার্জ। দশজন ডাক্তার চিকিৎসার কাজ সামলাচ্ছেন।
আমন্ত্রিত চিকিৎসকদের বক্তব্যের পর সংগঠকদের পক্ষ থেকে ডাঃ কুণাল দত্ত বলেন, বাজারের এই সর্বগ্রাসী প্রভাবকে কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে? কীভাবে নিজের স্বাস্থ্য নিজে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার পাওয়া যাবে? কীভাবে সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জন করা যাবে? তিনি সভায় উপস্থিত শ্রোতাদের আলোচনায় অংশ নিতে বলেন। শুভেন্দু দাশগুপ্তকে মন্তব্য করার জন্য অনুরোধ করা হয়। তিনি আলোচ্য বিষয়ের কতকগুলো প্রসঙ্গকে কিছুটা স্পষ্ট করে দেন। যেমন, তিনি বাজার এবং প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য না বলে ‘পুঁজির আধিপত্য’ কথাটা ব্যবহার করতে চান, যে পুঁজির সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার প্রযুক্তি। তিনি বলেন, বাঁকুড়া, হাওড়ার ফুলেশ্বর, বেলুড়ে যাঁরা চিকিৎসার কাজ করছেন, তাঁরা একটা রাজনৈতিক কাজ করছেন। সেখানে তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ‘নীতি’, যে নীতির কথা ইতিমধ্যেই শৈবাল জানা শহিদ হাসপাতালের কার্যক্রমের দিশা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর কথা শুনে মনে হয়, সত্তর-আশির দশকের জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন মেডিকাল কলেজগুলোর গণ্ডি ছাড়িয়ে যেভাবে বৃহত্তর সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল, তারই জের ধরে এসেছিল এইসব হাসপাতাল গড়ার আন্দোলন। ফলে নিজ নিজ রাজনৈতিক মন নিয়েই এইসব চিকিৎসকেরা কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের চিকিৎসক সত্তা অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার যৌক্তিকতার গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থেকে গেছে। ডাঃ শুভাশিস মিত্রের কথায় এসেছে যে ‘ডাক্তারিটা একটা সায়েন্স, সুতরাং অন্যান্য সায়েন্সের মতো তার মধ্যে প্রচুর ধন্দ থাকবে, থাকাটাই বাস্তব।’ তাহলে নিরাময়ের জন্য বিজ্ঞানের এই সীমাবদ্ধতার বাইরেও তো চোখ মেলে তাকানো দরকার। যেমন ডাঃ শৈবাল জানা বলেছেন ‘লোক-জ্ঞান’ প্রয়োগের কথা।
Leave a Reply