জিতেন নন্দী, ২২ জুন#
২১ জুন রবিবার এক বর্ষামুখর দিনে কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস সভাঘরে জড়ো হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ চিকিৎসক। এঁরা অনেকেই সত্তর-আশির দশকের এক স্বাস্থ্য আন্দোলনের মধ্যে থেকে উঠে আসা, আজ বয়সে কিছুটা প্রবীণ। এছাড়া ছিলেন আরও কিছু সমাজকর্মী। আলোচনার বিষয় ছিল ‘স্বাস্থ্যসেবার অযৌক্তিকতা’ (Irrationality of Healthcare)।
আলোচনার আগেই ইসিএল কেন্দ্রীয় হাসপাতালের প্রাক্তন ডিরেক্টর টি পুরকায়স্থ একটি অসম্পূর্ণ লিখিত নোট পাঠিয়েছিলেন। বিশেষ কারণবশত তিনি সভায় উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নোটে তিনি হাসপাতালের আইসিইউ (ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট) এবং মরণাপন্ন রোগীর চিকিৎসা নিয়ে লিখেছেন। চিকিৎসায় প্রযুক্তি অর্থাৎ আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসক কীভাবে কাজ করবেন, তা নিয়ে আলোচনা রয়েছে এই নোটে। ওঁর অনুপস্থিতির কারণে সভায় এই আলোচনা হতে পারেনি। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর যন্ত্রণা লাঘব করা এবং তাকে আশ্রয় দিয়ে শুশ্রূষা করার যে আন্দোলনের কথা বলেছেন, আমাদের চারপাশে তা নেই। অথচ প্রতি মুহূর্তে আমরা তার প্রয়োজন অনুভব করি।
সভার শুরুতে জয়া মিত্রের সূচনা ভাষণে নিরাময়ের প্রসঙ্গ যেন আলোচনার বিষয়বস্তুতে একটা তাৎপর্য্যপূর্ণ মাত্রা যোগ করে। প্রথম বক্তা ছিলেন কলকাতার ‘স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিন’-এর প্রাক্তন ডিরেক্টর পীযূষ কান্তি সরকার। গত আট বছর ধরে তিনি বাঁকুড়ার ছাতনা গ্রামে ‘আমাদের হাসপাতাল’ চালিয়ে যাচ্ছেন। সাড়ে ছয় একর জমিতে এই হাসপাতাল। বাঁকুড়া ছাড়িয়ে দুর্গাপুর ঝাড়খণ্ড পর্যন্ত প্রায় দু-আড়াই লক্ষ রোগী তাঁরা দেখেছেন। তিনি স্বাস্থ্যসেবা শব্দটার বদলেল চিকিৎসা শব্দটা ব্যবহার করতে চাইলেন। কারণ তাঁর মতে ‘সাহেবরাই স্বাস্থ্য মানে চিকিৎসা, এইভাবে বোঝাবার চেষ্টা করে। স্বাস্থ্য একটা খুব বড়ো ব্যাপার। হেল্থ সেন্টার নামে কতকগুলো বাড়ি তৈরি করা হল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কি স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু হয়, না স্বাস্থ্যের একটা সেগমেন্ট নিয়ে কাজ-কারবার হয়? স্বাস্থ্য তো শুধু চিকিৎসা নয়। …’ তাই বিষয়টাকে তিনি ‘চিকিৎসায় অযৌক্তিকতা’ করে নিলেন।
বাজারে চালু ৭০-৮০ শতাংশ ওষুধ অযৌক্তিক
‘হোয়াট ইজ র্যাশনাল, যৌক্তিক কী? দুই দশক ধরে এই চিন্তা ধরে কাজ করা হল। এরপর সাহেবরা আরও এগিয়ে গেল। বলল যে এভিডেন্স বেসড ট্রিটমেন্ট, র্যাশনাল হলে হবে না। মুশকিলটা হচ্ছে কি যে এই দুটো জিনিসই সমান তালে আমাদের দেশে চলেছে, যাদের হাই স্ট্যান্ডার্ড, তারা এই কথাটাকে ব্যবহার চালু করার চেষ্টা করছে, এভিডেন্স বেসড মেডিসিন। আমাদের দেশে এই পরিস্থিতিতে কি এভিডেন্স বেসড ট্রিটমেন্ট করা সম্ভব? না তার আগের স্টেজে আমরা আছি, পরে আমরা যাব এভিডেন্স বেসড মেডিসিনে? র্যাশানিলিটি কথা যখন এল, চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের অনাচার চলছে, সেই অনাচার এখনও আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে চলছে।
যেখানে একটা ওষুধ দিলে কাজ হয়, সেখানে তিনটে ওষুধ পাঁচটা ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। তারপরে যে ওষুধগুলো দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো ওষুধ বলা যাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ। আমাদের দেশে যত ওষুধ বাজারে আছে, তার ৮০ শতাংশ ওষুধ যদি বাজারে না থাকত, তাহলে ভালো হত। বাজারে চালু ৭০-৮০ শতাংশ ওষুধ অযৌক্তিক। শুধু তাই নয়, সেগুলো ক্ষতিকর, অকাজের। … কাশির সিরাপ বলে অন্য দেশে সেরকম কিছুই নেই। কেন? আমাদের দেশে কাশি হয়, বিদেশে হয় না? তারপর শক্তি বাড়ানোর বোতলের টনিক, চিকিৎসাশাস্ত্রে নেই। কোনো ডাক্তার তো দেখাতে পারবে না। তারা সব বড়ো বড়ো সেন্টারে কাজ করে, এভিডেন্স পেশ করে, সেখানেও ডাক্তাররাই লিখছেন টনিকের প্রেসক্রিপশন। …’
ডাঃ সরকারের বলেন এর পিছনে যদি ৩০% চিকিৎসকদের অজ্ঞতা থাকে, তাহলে বদমায়েসি রয়েছে ৭০%। অবশ্যই এর সঙ্গে আসে অপ্রতিরোধ্য বাজারের প্রশ্ন। এই পরিস্থিতিতে তিনি গ্রামের মানুষের চিকিৎসাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁর মতে, আমাদের দেশের ডাক্তারি শিক্ষাব্যবস্থায় কর্পোরেট হাসপাতালের জন্য ডাক্তার জোগানো হচ্ছে, গ্রামসমাজের জন্য নয়। যদিও শ্রোতাদের মধ্য থেকে প্রশ্ন ওঠে, আজকে চিকিৎসা ব্যবস্থার অরাজকতার শিকার গ্রাম এবং শহর উভয়েই।
ক্যানসার চিকিৎসার প্রথম কাজ রোগীকে ভয় দেখানো
ডাঃ স্থবির দাশগুপ্ত ক্যানসার চিকিৎসায় নিজের পঁয়ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতার কথা ধরেই চিকিৎসার যৌক্তিকতার আলোচনায় প্রবেশ করেন। এভিডেন্স বেসড মেডিসিন বা প্রমাণ ভিত্তিক ওষুধ প্রয়োগের যে আলোচনা আগেই উঠেছিল, সেই সূত্র ধরেই তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যের কোনো সংজ্ঞা হয় না। … স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্বাস্থ্যসেবা কথাগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক অর্থ নেই। … আপনি যদি মহিলা হন, আপনি যদি বিয়ে না করেন, তাহলে আপনার ব্রেস্ট ক্যানসার এই হল বলে! আর আপনি যদি বিয়ে করেন, তাহলে তো আপনার সার্ভাইকাল ক্যানসার হবেই। মডার্ন মেডিসিন মহিলাদের নিয়ে যতটা চিন্তিত, পুরুষদের নিয়ে ততটা না। … এ তো অদ্ভুত কথা! তাহলে আপনি যাবেন কোথায়? আপনার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আপনি হাসপাতালে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, দেখুন তো ক্যানসারটা হল কিনা? বলা হয়, স্ক্রিনিং হলে খুব আর্লি ডিটেকশন হয়। আর্লি ডিটেকশন বলে আদৌ কিছু নেই চিকিৎসাশাস্ত্রে। … বিশেষ করে আমি একটা উদাহরণ দিচ্ছি। একটা বইয়ে পড়েছি … কতটা মারাত্মক কোন ক্যানসার … একটা খাঁচায় একটা খরগোস রাখা আছে, একটা কচ্ছপ রাখা আছে, একটা পাখি রাখা আছে। একটা কচ্ছপ, সে খুব ধীরে ধীরে চলে, অত ক্ষতিকর নয়। একটা খরগোস মোটেই ধীরে ধীরে চলে না এবং সেটা কামড়ে-টামড়ে দিতে পারে আর একটা পাখি, সে ফুড়ুৎ করে উড়ে যেতে পারে। তিনরকম ব্রেস্ট ক্যানসার, কোনটা আপনি স্ক্রিনিং করে আবিষ্কার করবেন? পাখির মতো কেস তো কোনোদিনই স্ক্রিনিংয়ে ধরা পড়ে না। যে ধরনের ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়লে সুবিধা হত, তা খুব কমই ধরা পড়ে। যেটা বেশি ধরা পড়ে, তা হল ওই কচ্ছপের মতোটা। আমরা কিন্তু ওইটা ধরেই দামামা বাজাই স্ক্রিনিংয়ের পক্ষে। সেইজন্যই পণ্ডিতরা বলছেন, সত্যি সত্যি এর কোনো এভিডেন্স নেই।
যৌক্তিকতার প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা হল একটা গতিমুখ বা দৃষ্টিভঙ্গি। … রেডিওলজি তিন সপ্তাহ চার সপ্তাহ ছ-সপ্তাহ হল, খুব দরকার হলে কয়েক বছর পরে দিতে হল। কিন্তু কেমোথেরাপি নরমালি ছয় থেকে আট মাস চলে। যেহেতু নতুন ওষুধ বাজারে এসেছে এবং যেহেতু আমরা মডার্ন মেডিসিনের চর্চা করি, অতএব আমরা ধরে নিই যে আমরা হাতে গরম মেডিসিনের চর্চা করি, দু-বছর আগে যে ওষুধটা বাজারে এসেছে, সেইটা যদি আমি ব্যবহার না করি, তাহলে আমারই কলিগরা আমাকে বলবে, আপনি এই ওষুধটা দেননি কেন? আপনি রোগীটাকে মেরে ফেলবেন? এই নাকি মডার্ন মেডিসিন? আমি তো জানি যে ওই ওষুধটা দিলে ১০ থেকে ১২ লক্ষ টাকা খরচ হবে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে যে তাতে তার সেরে যাওয়ার কথা নেই, উপকার পাওয়ার সম্ভাবনা ২০-৩০\%। … এইটা যদি যৌক্তিকতা হয়, এই যৌক্তিকতাকে আবিষ্কার করেছে মডার্ন ওয়ার্ল্ড। সত্তরের দশকে আমরা যে ব্রিটিশ মেডিসিনের চর্চা করেছি, তখন কিন্তু এই যৌক্তিকতা গজায়নি। … এই মেডিসিনের চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, এই প্রতিষ্ঠানটাকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা সানন্দে সেটা গ্রহণ করেছি, কেননা তাতে টাকা আসে। আর কে না টাকা চায়! আমরা চর্চা করতে গিয়ে দেখলাম, যৌক্তিকতা হল এর প্রথম বলি। দ্বিতীয় বলি হল আমাদের রোগী। যৌক্তিকতা যদি প্রথম বলি হয়, তাহলে আমরা সেটাকে কীভাবে পালটাব, কীভাবে চ্যালেঞ্জ করব? … একটা হচ্ছে সমস্ত চিকিৎসা নিয়ে পাবলিক ফোরামে সমস্ত আলোচনাটা করতে হবে। আমরা যদি কয়েকজন ডাক্তার মিলে একটা ঘরে বসে চুলচেরা আলোচনা করি, তার ফল হবে জিরো। এটা হয় না। সাধারণ মানুষকে যুক্ত করতে না পারলে কোনো যৌক্তিকতাতেই পৌঁছানো যায় না। …’
mitra chatterjee says
bhalo pratibedan…aro anek beshi loker kachhe pouchhono dorkar