৪ ফেব্রুয়ারি, জিতেন নন্দী, গুরগাঁও, হরিয়ানা#
আজ খোলামেলা কথাবার্তা হল সতীশ জৈনের সঙ্গে। রাজস্থানের সাওয়াই মাধোপুর থেকে তিনি এসেছেন দিল্লিতে, আম আদমি পার্টির নির্বাচনী লড়াইয়ের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে খাটছেন। তিনি পেশায় পর্যটন ব্যবসায়ী। দিল্লিতে তাঁর নিয়মিত আসা-যাওয়া রয়েছে। কথার সময়ে আমাদের সঙ্গে ছিলেন রাজেশ কুমার। ইনিও কর্মসূত্রে দিল্লি নিবাসী।
রাজেশ কুমার : আমাদের এখানে দিল্লি জল বোর্ড সরকারি জল সরবরাহ করে। মাঝেমাঝেই বলে পা ইপলাইন ব্লক হয়ে গেছে, ভেঙে গেছে, এইসব বলে জল বন্ধ করে দেয়। দশদিনে একবার তো এরকম হবেই। এখানে এত উঁচু উঁচু সব বিল্ডিং, সব বাড়িতেই মোটর লাগিয়ে ফ্ল্যাটগুলোতে জল সরবরাহ করা হয়। জল ছাড়া পায়খানা বাথরুম যাওয়া, রান্নাবান্না, সমস্ত কাজ বন্ধ। দক্ষিণ দিল্লিতে জলের সমস্যা লেগেই আছে। কেন্দ্রীয়ভাবে উত্তরপ্রদেশ থেকে জল আসে এখানে। প্রাইভেট ট্যাঙ্কারওয়ালারা আসে। ঠিকেদারকে ফোন করতে হয়। জল বোর্ডকে ফোন করলে আসে না। আজ বুক করলে আসবে তিনদিন পরে। বলবে, জল নেই। প্রাইভেট ট্যাঙ্কার, কারও ৫০০, ৭০০ বা ৩০০ টাকা রেট। জল কিন্তু পরিষ্কার নয়। সেই জল নিয়েও লড়াই লেগে যায়। কে আগে নিজের লাইনে জল নেবে। সকাল ন-টায় লোক অফিস যাবে, স্নান-টান করে তো বেরোতে হবে। ন-টা দশটার সময় ভিড় আর মারামারি লেগে যায় জলের জন্য। এক-একটা ট্যাঙ্কে বারো-চোদ্দো হাজার লিটার জল আসে। পাইপ দিয়ে বিল্ডিংয়ের নিচের ট্যাঙ্কে জল ভরে দেয়, এক হাজার লিটার পাঁচশো টাকা। সেই জল মোটর দিয়ে ছাদের ওপরের ট্যাঙ্কে তুলে দেওয়া হয়। সেখান থেকে যায় ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে। এক-একটা ট্যাঙ্কার থেকে ছ-সাত হাজার টাকা আয় হয় ঠিকেদারদের। মাসে তিন-চারদিন এরকম চলেই। সরকারি জলের জন্য আমাদের বিল মেটাতে হয়। সকাল পাঁচটায় জল চলে আসে। এক ঘণ্টা থাকে সেই জল। তার মধ্যেই মোটর দিয়ে ওভারহেড ট্যাঙ্ক ভরে নিতে হয়। সরকারি জলের রেট হল এক হাজার লিটার তেরো টাকা।
সতীশ জৈন : রাজেশ যেরকম বলল, ঠিক এইভাবেই ট্যাঙ্কার-মাফিয়ারা সাধারণ নাগরিকদের লুঠ করে। জল ছাড়া তো জীবন চলে না। আম আদমি পার্টি যখন ৪৯ দিনের সরকারি ক্ষমতায় এল, এরা দিল্লি জল বোর্ডের অফিসারদের বিভিন্ন জায়গায় বদলি করে দিয়ে পুরো চক্রটাকে ভেঙে দিল। এর আগে দশ বছর এক জায়গায় কাজ করে ওই অফিসাররা নিজেদের চক্র বানিয়ে নিয়েছিল। অরবিন্দ কেজরিওয়াল এসে বললেন, পুরো হিসেব-নিকেশ দিতে হবে, জল বন্ধ করলে তার কারণ দেখাতে হবে। ট্যাঙ্কার-মাফিয়াদের প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লোকসান হতে লাগল। বহুদিন ধরে দিল্লি এমসিডি-তে (মিউনিসিপাল কর্পোরেশন অফ দিল্লি) এই জিনিস চলে আসছে। এতে কংগ্রেস-বিজেপি কোনো ফারাক নেই। উনপঞ্চাশ দিন কাউকে জলের জন্য ঠিকেদারকে ডাকতে হয়নি। কেন্দ্রীয়ভাবে একটা কল-সেন্টার রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে আদেশ যেত যে তোমাকে এই জায়গায় জল পাঠাতে হবে। ট্যাঙ্কার-মাফিয়াদের সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিল।
শীতকালে আমাদের সাওয়াই মাধোপুর জেলা থেকে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৫০ ট্রাক পেয়ারা আসে দিল্লিতে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ওখানে প্রচুর পেয়ারা ফলে। ওই গাড়িগুলো যখন দিল্লি বর্ডারে আসে, তখন প্রত্যেক গাড়িওয়ালার কাছ থেকে পুলিশ এক হাজার টাকা করে ঘুষ আদায় করে। এছাড়া নানারকম হয়রানি আর সময় নষ্ট তো করেই। নয়া দিল্লিতে এই পুলিশকে বলে পাঁচ নম্বর ট্রাফিক পুলিশ। আমার বহু পড়শি এই গাড়িওয়ালাদের কাজে যুক্ত। কেজরিওয়ালের ৪৯ দিনের সরকার থাকাকালীন এই পাঁচ নম্বর ট্রাফিক পুলিশেরা কারও কাছ থেকে এক পয়সাও চাইতে আসেনি। এর ফলে ট্রান্সপোর্টারের পয়সা বেঁচেছে, ব্যবসায়ীর লাভ হয়েছে আর ক্রেতাও উপকৃত হয়েছে। আগে ট্রাফিক পুলিশের হুজ্জুতির জন্য লোকের হয়রানি হত, সময় আর পয়সাও যেত। ওইসময় পুলিশওয়ালারা বুঝতে পেরেছিল যে আমরা এমনিতে তো পঞ্চাশ হাজার টাকা কামাচ্ছি, একশো টাকা ঘুষ খেতে গিয়ে কেরিয়ারটাই বরবাদ হয়ে যাবে। লোকে মোবাইলে ভিডিও করে নিয়ে কেজরিওয়ালকে পাঠিয়ে দিয়েছে আর ওইসব ঘুষখোর কর্মচারী সঙ্গে সঙ্গে সাসপেন্ড হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ যেমন উপকৃত হল, পাশাপাশি বুঝতে পারল যে আমারও একটা নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে সরকারকে সহায়তা করার।
জিতেন : পশ্চিমবঙ্গে আমরা দেখি, সাধারণ মানুষও ঘুষ দিতে চায় সরকারি অফিসে …
সতীশ জৈন : এটা একটা সিস্টেম হয়ে গেছে। পয়সা না দিলে তো আপনার সঙ্গে কথাই বলবে না অফিসার। কিন্তু অ্যাকাউন্টেবিলিটি বলে যদি কিছু থাকে যে একটা সময়-সীমার মধ্যে কাজটা হতে হবে, তাহলে পয়সা কেন দিতে হবে? যে বাবু আপনার একটা দরখাস্ত নিয়ে ছ-মাস বসে থাকে, তার তো কোনো অ্যাকাউন্টেবিলিটি নেই। সে দিব্যি সারাদিন বসে চা খাচ্ছে, সিগারেট খাচ্ছে, ফাইল যেমন-কে-তেমন পড়েই আছে। সরকারের তো এটা দায়িত্ব যে ওই বাবুকে দিয়ে কাজ করাতে হবে। সরকারি কর্মচারীর যেদিন চাকরি চলে যাওয়ার ভয় পয়দা করতে পারবে সরকার, সেইদিন তো সে কাজ করবে। এখন তো সেই ভয় নেই। ফাইল পড়ে আছে, দু-চারদিন দেখো, তারপর তার সঙ্গে কথা বলো, ভিডিও করে নাও আর কেজরিওয়ালকে পাঠিয়ে দাও। ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন।
জিতেন : এসব খবর তো মিডিয়াতে সেরকম আসেনি।
সতীশ জৈন : সমস্ত মিডিয়া তো সরকারি পয়সায় চলে। যার সরকার তার গান তো ওদের গাইতেই হবে। এরকম কমই মিডিয়া আছে, যারা গরিবের কাছে গিয়ে কিছু শুনতে চায়, তাদের কথা হাইলাইট করতে চায়। তারা তো উঁচু ক্লাসের ভদ্রলোকেদের কাছে যায়, যারা তথাকথিত সভ্য নাগরিক, ভালো স্যুট-বুট পরে ঘোরে তাদেরই ইন্টারভিউ নিয়ে আপনার কাছে পেশ করে। মিডিয়া মাটির কাছের সত্যকে প্রকাশ করে না। সরকার বিজ্ঞাপন না দিলে তো খবরের কাগজ বন্ধ হয়ে যাবে, সরকারই তো ওদের পোষে।
এদেশে সব লোকেই জানে যে দেশের সমস্ত কাজ চলে কমিশনখোরির মাধ্যমে। এক টাকার জিনিস যদি দশ টাকায় না কেনা যায় তো সরকারের কাজ চলবে কী করে? ঠিকেদার কামায়, অফিসার কামায়, নেতা কামায় আর যে আদেশ দেয় সেও কামায়। নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত একটা চেন তৈরি হয়ে রয়েছে। এদেশে পয়সার ৭০% লিকেজ হয়ে যায়, বাকি ৩০% কাজ হয়। একই জিনিস চলছে দিল্লির ডিসকম-এ। ৫০-৫০ পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে এটা চলছে। ডিসকমে কী করে রেখেছে এরা, এদের প্রাইভেট পার্টনাররা তাদের সিস্টার কনসার্ন থেকে বেশি দামে জিনিস কেনে। ১০০ টাকার জিনিস ১০,০০০ টাকায় ওই কনসার্ন থেকে কেনা হয়। সেই পয়সা মেটায় ওই প্রাইভেট কোম্পানি। তাতে কস্ট বেড়ে যায় আর সেটা উশুল করে পাবলিকের ঘাড় থেকে। তারপর কোম্পানি লস দেখায় আর সেটা উশুল করে সরকারের ঘাড় থেকে। এইভাবে মাঝখানে সিস্টার কনসার্নকে রেখে এক পকেট থেকে অন্য পকেটে টাকা ঢোকায় এরা। ডিসকম হল বিদ্যুৎ সরবরাহের সংস্থা, ইলেকট্রিসিটি ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। বিএসইএস হল অনিল আম্বানির কোম্পানি, টাটা পাওয়ার টাটার। এই দুটো দিল্লির বড়ো কোম্পানি আর একটা হল এনডিএমসি। এনডিএমসি-র রেট কেন বিএসইএস আর টাটা পাওয়ারের চেয়ে কম? এনডিএমসি-র বিল যেখানে ৭০০ টাকা আসে, টাটা পাওয়ারের আসে ৩০০০। একই বিদ্যুৎ, একই শহরে কেন দুটো রেট? ঘাপলাটা কী? এনডিএমসি পুরো সরকারি নিয়ন্ত্রণে। এক একটা এলাকা এক একটা কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউশন। এনডিএমসি সাপ্লাই করে সরকারি কর্মচারীদের আবাস-এলাকায়। তাহলে যারা সাধারণ প্রাইভেট আদমি তাদের লুঠ করো! টাটা পাওয়ার আর বিএসইএস হাই-রেটে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে আর দিল্লির সরকার দেখাচ্ছে যে ওদের লোকসান চলছে। কারণ ওদের পারচেজ কস্ট বেশি, মেইন্টেন্যান্স কস্ট বেশি। তো এই লোকসান কে মেটাবে? প্রাইভেট স্টেক-হোল্ডারের লোকসান তো সরকারকেই মেটাতে হবে। আর পাবলিককে ২০০০ টাকার জায়গায় ১৫,০০০ টাকা ইলেকট্রিসিটি বিল মেটাতে হচ্ছে।
কেজরিওয়াল দাবি করেছিলেন যে এরা যখন পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে জনসাধারণের সেবার জন্য কাজ করছে, তখন কেন এদের সিএজি (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল-এর দপ্তর) অডিট হবে না? শীলা দীক্ষিতের সরকার জবাব দিয়েছিল যে এরা হাইকোর্ট থেকে স্টে অর্ডার নিয়ে রেখেছে। সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেছে সরকার। কেজরিওয়াল যখন সরকারে এলেন, সমস্ত ফাইল চেক করে দেখলেন যে কোনো স্টে অর্ডার নেই। তিনি সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নিলেন এবং সিএজি অডিটের অর্ডার পাশ করে দিলেন। বিদ্যুৎ কোম্পানিদের ভাগ-দৌড় শুরু হয়ে গেল। কেন? ওই যে ঘাপলা। যদি ওরা ইমানদার হত, তাহলে সিএজি অডিটে অসুবিধা কী ছিল? ওরা তো তোমার ফাইলগুলোই চেক করে দেখবে। সমস্ত মিডিয়া আর গভর্নমেন্ট ডিসকম-কে ডিফেন্ড করতে মাঠে নেমে পড়ল। কারণ ওরা তো সব এক। কেজরিওয়াল যখন ইস্তফা দিলেন, ডিসকম আর সব কোম্পানি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আজ এক বছর হয়ে গেছে সিএজি-কে অর্ডার দেওয়া হয়েছে, অডিট হল না কেন? এই কোম্পানিরা অডিটে সাহায্য করছে না আর কেন্দ্রীয় সরকার তাদের শেল্টার দিচ্ছে।
উনপঞ্চাশ দিনে বিদ্যুতের দাম পঞ্চাশ ভাগ কমে গিয়েছিল, সরকার ভরতুকি দিয়ে এটা করেছিল। যার ৭০০ টাকা বিল আসত, তার ৩৫০ হয়ে গিয়েছিল। কথা উঠল যে জনসাধারণের পয়সায় ভরতুকি দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, সেটা তো ভালোই, নিজে তো খায়নি ওই পয়সায়। তোমরা তো শত শত কোটি টাকা দিয়ে নিজেদের জন্য এরোপ্লেন কিনছ। তোমরা ৭০০০ কোটি টাকা লোন দিয়েছ আদানি-কে দেড় পার্সেন্ট সুদে। এসবিআই তো সেক্ষেত্রে ১৪% সুদ নিত। আদানি অস্ট্রেলিয়ায় মাইনিং করবে, তার জন্য তোমরা লোন দিচ্ছ, তাতে পাবলিকের কী লাভ? এটা একটা কর্পোরেট চক্র, সরকার তাদের কাঠপুতুল। সরকার তো একটা ঘোড়া, তার পিঠে সওয়ার হল কর্পোরেট, তাদের হাতেই লাগাম। ও সরকারকে থামতে বললে থামবে, চলতে বললে চলবে।
জিতেন : সওয়াই মাধোপুরে বাস করে দিল্লির কেজরিওয়ালের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীভাবে তৈরি হল?
সতীশ জৈন : আরটিআই-এ (রাইট টু ইনফর্মেশন আইন) কেন্দ্রীয় সরকার কিছু পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল। একটা বিল আনার কথা হচ্ছিল। আমরা ওখানে তার বিরোধিতা করলাম। সেই সময় আমাদের ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ হল। আমার এক বন্ধু একটা সংস্থা সওয়াই মাধোপুরে তৈরি করেছে, কনজিউমার লিগাল হেল্প সোসাইটি। ২০০৫ সাল থেকে ওর এখানে যোগাযোগ। সওয়াই মাধোপুরে আমরা আরটিআই ফাইল করে চলেছি। কিন্তু ওখানে পরিস্থিতিটা দুঃখজনক। সরকার বেশরম, সবাই জানে কোথায় ঘাপলা, কিন্তু ওরা কিছু করবে না। আমাদের দেশে একটা রাস্তা ভেঙে গেলে রাস্তা সারানো হবে, কিন্তু কেন রাস্তাটা ভাঙল, সেটা দেখা হবে না। জল জমার জন্য, ঘাটিয়া মাল দিয়ে বানানোর জন্য না অতিরিক্ত ট্রাফিকের জন্য রাস্তা ভাঙল, সেসব দেখা হবে না। ছ-মাসে রাস্তাটা ভেঙে গেল, সারানো হল, আবার ছ-মাস পর ভেঙে গেল। যতক্ষণ কারণটা নিয়ে মন্থন হবে না, পরিস্থিতির বদল হবে না। ঠিকেদার পয়সা খাচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার খাচ্ছে, অফিসার খাচ্ছে আর অর্ডার লিখে দিচ্ছে। একটা রাস্তা একশোবার বানানো হবে, কিন্তু তার কারণ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। এই হল আমাদের ব্যবস্থা। একে বদলানোর জন্যই আম আদমি পার্টি। ব্রিটিশের তৈরি জমি অধিগ্রহণ আইন এখনও চলছে। কংগ্রেস সরকার তার কিছু বদল করেছে। বিজেপি সরকার এসে আবার তাকে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে এনেছে। এ হল কর্পোরেট আর সরকারের আঁতাত, যারা দেশকে লুঠছে।
জিতেন : দেখুন, আম আদমি পার্টি প্রত্যেক মহল্লায় রেসিডেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন গড়ার কথা বলছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সাধারণ সভা করে তার নেতা নির্বাচন হবে, কী কী কাজ হবে, সাধারণ লোকেই ঠিক করবে। ভালো কথা। পশ্চিমবঙ্গেও মিউনিসিপ্যালিটির প্রত্যেক ওয়ার্ডে ওয়ার্ড কমিটি আছে। কিন্তু তাতে পার্টি বা তাদের পছন্দের লোকেরাই থাকে। সাধারণ মানুষ তাতে অংশ নেয় না। সাধারণ মানুষ যদি নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে সমস্ত অ্যাসোসিয়েশনই তো বেকার হয়ে যাবে?
সতীশ জৈন : দিল্লি লেখাপড়া জানা মানুষের একটা রাজ্য। প্রথমত, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে উদ্যোগী করা যেতে পারে। প্রত্যেক মহল্লায় মহল্লা-সভা তৈরি হবে। এটা জরুরি নয় যে আপনাকে সাধারণ সভায় হাজির থাকতেই হবে। মহল্লায় এক হাজার লোক আছে। সভায় একশো লোক হাজির হল। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। ক্ষমতা থাকছে সরকারের হাতে, কমিটির হাতে নয়। আপনাকে সরকার জানাবে যে তোমার মহল্লার জন্য এত টাকা অনুমোদন রয়েছে, তুমি সুপারিশ করো কীভাবে এই টাকা খরচ হবে। কোনটা তোমার মহল্লায় এখনই দরকার, কোনটা পরে হলেও চলবে। এটা আপনাকে বলতে হবে। এর বাইরে আপনার কোনো ক্ষমতা নেই। মহল্লায় আলো দরকার, নালা দরকার, জল দরকার, সাফাইয়ের কাজ হওয়া দরকার। এসবের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু সিস্টেমটা ঠিক মতো কাজ করছে না। সরকার যদি দায়িত্বশীল হয়, সরকারি কর্মচারী কাজ করবে। কোনো অভিযোগ হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেবে। আজ আপনি যতই অভিযোগ করুন, সরকার তা শুনছে না। সরকার কল সেন্টার তৈরি ক্রবে। সেখানে কমপ্লেন রেজিস্টার করা হবে। সেই কমপ্লেন অনুযায়ী অ্যাকশন নেওয়া হবে। যদি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কমপ্লেন হয়, এক সপ্তাহের মধ্যে বিচার করে অ্যাকশন নেওয়া হবে। এখন তো কমপ্লেনের কাগজ পকেটে পুরে রেখে দেওয়া হচ্ছে, কোনো অ্যাকশন নেই।
জিতেন : কেজরিওয়াল বলেছেন, আমি মুখ্যমন্ত্রী নই, আম আদমি মুখ্যমন্ত্রী। এটা একটা কথার কথা। যদি আম আদমি সক্রিয় না হয়, তাহলে এসব কথার কোনো মানেই থাকে না। আমরা পশ্চিমবঙ্গে দেখেছি, সাধারণ মানুষ ব্যক্তিগতভাবে কোনো উদ্যোগ নেয় না, কোনো সভায় যায় না …
সতীশ জৈন : এর কারণ হল, গুণ্ডাবাজীর ভয়। মহল্লা কমিটিতে যদি গুণ্ডাদের আধিপত্য থাকে, গুটিকতক গুণ্ডাকে এক হাজার লোক ভয় পাবে। এইভাবেই তো সিস্টেমটা চলছে। গুণ্ডাদের ভয় দূর করার জন্য পুলিশকে অ্যাকশন নিতে হবে। সিস্টেমটা ওপর থেকেই বদল করতে হবে। প্রেরণা হল জলের মতোই, ওপর থেকে নিচে আসে। সাধারণ মানুষ ইজ্জতের সঙ্গে বাস করতে চায়, দাঙ্গা-ফাসাদ চায় না। এমনকী গুণ্ডারাও নিজেদের সংসারে শান্তি চায়। পুলিশকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আজ ইনস্পেক্টর-রাজ চলছে। সিস্টেমটা এমন এক জিলিপির প্যাঁচের মতো হয়ে রয়েছে, কারও স্বাধীনভাবে কিছু করার উপায় নেই।
জিতেন : আপনি কতগুলো সভায় অংশ নিয়েছেন?
সতীশ জৈন : মোটামুটি ত্রিশটা হবে।
জিতেন : এই ত্রিশটা সভায় আপনি কোনো আম আদমিকে বক্তব্য রাখতে দেখেছেন?
সতীশ জৈন : এটাই এই দলের বিশেষত্ব। মহল্লায় যখন কোনো ছোটো সভা হচ্ছে, যতক্ষণ না বাইরের নেতা আসছেন, মহল্লার লোকেই বলছে। কোনো বাসিন্দা এসে কিছু বলতে চাইল, তাকে বলতে দেওয়া হচ্ছে। বহু লোককে আমি বলতে শুনেছি। কৃষ্ণনগরে, যেখানে কিরণ বেদি প্রার্থী, আমি একটা সভায় গিয়েছিলাম। সেখানে দু-ঘণ্টা দেরি হল বাইরের নেতা আসতে। স্থানীয় লোকেরাই বক্তব্য রাখল, নাটকীয় ভাষায় নয়, নিজের ভাষায় নিজের মনের কথা বলল।
জিতেন : রাজস্থানের সওয়াই মাধোপুরের সাধারণ মানুষ নিশ্চয় এতটা সক্রিয় নয়?
সতীশ জৈন : ওখানে এখনও লোকের মোহ কাটেনি। এখানে মোহ কেটে গেছে। আসলে দিল্লি প্রধানমন্ত্রীর নাকের নিচেই রয়েছে। এখানকার লোক সব দেখতে পাচ্ছে। প্রদীপের নিচেই থাকে অন্ধকার। দিল্লির লেখাপড়া জানা বাসিন্দাদের কীভাবে বেওকুফ বানিয়ে রাখবে? তারা তো সব কিছু দেখতে পাচ্ছে।
জিতেন : আপনি যে অতদূর থেকে এখানে এসে রয়ে গেছেন, এতে আপনার তো ক্ষতি হচ্ছে, পরিবারের …
সতীশ জৈন : দেখুন, আমরা তো কত কিছুই খুইয়েছি। এক মাস বা পনেরোদিনের জন্য বিরাট কিছু লোকসান হয়ে যাবে না। সামলে নেওয়া যাবে। দেশের পরিস্থিতির যদি ১০% বদল হয়, তাতে আমারও লাভ।
জিতেন : রাজস্থান থেকে কতজন স্বেচ্ছাসেবক এসেছে?
সতীশ জৈন : রাজস্থান থেকে পাঁচশোর মতো লোক এসেছে। সওয়াই মাধোপুর থেকে ১২ জন, জয়পুর থেকে বহু লোক এসেছে, গঙ্গানগর থেকেও অনেকে এসেছে, মানগড়। আসাম, বাংলা, উড়িষ্যা, কেরল, সমস্ত রাজ্য থেকে লোক এসেছে। আমেরিকা, জাপান, নরওয়ে থেকেও এসেছে। সকলেই তারা ক্রান্তিকারী। আমি কখনও রাজনীতি করিনি। আন্না হাজারের আন্দোলনে প্রথম আমি এই পথে এসেছি। আমার বিচার ক্রান্তিকারী শুরু থেকেই ছিল। যাদের চারপাশে দেখছি, সকলেই ক্রান্তিকারী যুবক, কেউই সুবিধাবাদী নয়। ২০ বছর থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে সকলের বয়স। ৯৯.৯% যুবক। বয়স্ক লোক খুব কম এসেছে। এই যুবকেরা কলেজে পড়েছে, কোনো রাজনীতি সেখানে করেনি, সেইসব ছেলেরাই মূলত এসেছে। যারা রাজনীতিকে নোংরা বলে এসেছে, সেই লেখাপড়া জানা যুবকেরা দেশের লাগামটা হাতে নিতে চাইছে, এটাই সবচেয়ে শুভ। এটাই এই আন্দোলনের সাফল্য।
Leave a Reply