প্রাইভেট টিউশন থেকে ফেরার পথে দু’একদিন কথা হয় বুড়োকাকুর সাথে। লকডাউনে কে কেমন আছি একদিন জানতে চেয়েছিল। সেই খবর লেখা হল।
দেবরূপ বণিক। শান্তিপুর। ১৪ জুলাই, ২০২০। #
অনেককাল পর আসা একটি ঝড় হল লকডাউন। সারাদিন বাড়িতে বসে থেকে সময় কাটানোর এক পরীক্ষা এটি। আমার মত ক্লাস টেনে পড়া বা তার ছোট বা তার থেকে বড়রাও আগে এমন ঝড়ের মুখোমুখি হয়নি। করোনা নামক রোগ যখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন প্রথমে এটির ওষুধ তৈরির কথা চিন্তা করা হয়। এবং পরে যখন জানা যায় ওষুধ তৈরি হতে সময় লাগে, তখন এই লকডাউন ডাকা হয়। ঘর থেকে লোকেদের বেরনো বন্ধ হয়ে যায়। তবে সবথেকে করুণ অবস্থা ছিল তাদের যারা বাইরে গিয়ে কাজ করে। যারা বাড়ি ফিরতে চাইছিল। হেঁটে হেঁটে পায়ের চামড়া ছিঁড়ে শহরের রাস্তায় এলে তাদের চেনাশোনা লোকেরাও তাদের তাড়িয়ে দেয়। টিভিতে এসব দেখে যখন পড়তে বসি , সেই টিভির সামনে নিজেকে তখন বড় সুখী মনে হয়।
এই আমার মত যারা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে চলেছে তারা নিশ্চিত জানে যে টিভিতে আমাদের লাইভ ক্লাস নেওয়ার কথা হয়েছিল। তার সম্পর্কে আমার আর কিছু বলার নেই। যদি এটা ক্লাস ওয়ানের ছাত্রদের পরীক্ষায় আসে তবে বিষয়টা হবে এমন- একঘন্টার ক্লাসে যদি তিনটে ক্লাসকে পড়ানো হয় এবং তাতে থাকে পনের মিনিটের ব্রেক, তবে এক একটি ক্লাসকে কতক্ষণ পড়ানো হবে? উত্তরটা হল পনের মিনিট। এবার আমার প্রশ্ন পনের মিনিটের ক্লাসে কোনো ছাত্র কীভাবে পড়তে পারে এবং কতদিনই বা চলল এই লাইভ ক্লাস? আমার যতদূর মনে পড়ে তিনসপ্তাহের বেশি টেকেনি। আর আমার মত যারা ছাত্র তারা নিশ্চয়ই জানো যে টিভির পর্দায় দেখানো কোনো লেখাই বোঝা যায়না। ক্রমে দিন বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে সকল স্যার ম্যাডামরাও অনলাইনে পড়ানো শুরু করে দেয়। এরমধ্যেও কিছু লোকেরা গোমূত্র পানে করোনা পালাবে- এই সমস্ত কথা রটানো শুরু করে। তখন আমরা সকলে অবাক হয়ে টিভির সামনে বসে থাকি। এই লকডাউনে আমরা হারাই তিনজন অভিনেতাকে। তবে সবথেকে বেশি মনে পড়ছিল সেই বখাটে ছেলেগুলোর গল্প, বাড়ির সামনে।
ছাত্রজীবনে লকডাউন : ছাত্রজীবনে লকডাউনের সাথে সাথে তাদের খেলাধুলা থেকে পড়াশুনা পর্যন্ত এর প্রভাব আছে। খেলাধূলার কথা জানিনা তবে পড়াশুনা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে হয়েছে আমাদের। সবুজ মাঠ, হলুদ ফুল, নীল আকাশ এবং বিভিন্ন রঙের পাখিদের ডাকে আমরা যেতে পারিনি।
লকডাউনে উৎসব : মার্চ মাসের পর থেকে দেখতে দেখতে আমাদের চোখের সামনে গুড ফ্রাইডে, চড়ক পুজো, নববর্ষ, অক্ষয় তৃতীয়া, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী একের পর এক উৎসব কেটে গেল। আমাদের অবাক এবং দুঃখওয়ালা চোখ কেবল ক্যালেন্ডারের দিকে।
সূর্যগ্রহণ : এতকিছুর পর সূর্যগ্রহণকে লকডাউন আটকাতে পারেনি। ছাত্রদের জীবনে হয়তো চোখ মেলে সূর্যগ্রহণ দেখার এটাই প্রথম সুযোগ। এত কিছুর পর সূর্যগ্রহণের হালকা আলোর ছায়ায় ফটোগ্রাফি প্লেটের আড়ালে ছাত্রদের মুখে হাসি ফুটল।
স্কুলের প্রতি টান : যে স্কুলকে ছাত্ররা নিজের চোখে দেখে এসেছে তাও লকডাউনে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকার পর এক মায়ার অধিকারি হয়ে ওঠে। ছাত্রদের চোখে এই সময় ফুটে উঠেছে স্কুলের ছবি, সেখানকার মাঠে খেলার ছবি এবং বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার ছবি।
বন্ধুর অভাব : দুঃখে চোখের জল মোছার মতন পাশে পাওয়া বন্ধুকে আর খুঁজে পাইনি কেউ, যখন চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। এই লকডাউনের দেয়াল আলাদা করেছে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে।
রথে লকডাউন : এইবার রথের রশিতে টান পড়েনি। আমাদের মত ছাত্ররা আর যেতে পারেনি রথ দেখতে। বাবা মার হাত ধরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রথ দেখার মজা থেকে আমরা আজ বঞ্চিত।
নতুন বন্ধু ঘুড়ি : আমরা ছাত্ররা এক নতুন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি- তা হল ঘুড়ি। এই ঘুড়ি আজ আকাশে উড়ে মুখের হাসির কারণ হয়ে উঠেছে।
Leave a Reply