চূর্ণী ভৌমিক, কলকাতা, ১৫ এপ্রিল#
বীণাপিসি আমাদের বাড়িতে কাজ করেন। যখন তিনি অনেকদিনের জন্য আসেন না, তখন তাঁর হয়ে কাজ করে দিয়ে যান তাঁর দিদি কিংবা জা কিংবা অন্য কোনো আত্মীয়-বন্ধু। সেই সূত্রেই ঝর্ণামাসিও এসেছিলেন বীণাপিসির হয়ে কাজ করতে। ৫-৭ দিন ঝর্ণামাসি বীণাপিসির জায়গায় কাজ করেছিলেন। তারপর ঝর্ণামাসির কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। হঠাৎ সেদিন খবর পেলাম ঝর্ণামাসির মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি। অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ঠিক কী যে হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু অবস্থা খারাপ। বর মেরেছে কিনা তাও জানা যাচ্ছে না। কিন্তু বীণাপিসির সেরকমটাই আশঙ্কা। বিশের কোঠায় বয়স মেয়েটির, একটা বাচ্চাও রয়েছে। এর দু-তিন দিন বাদেই তার মৃত্যুসংবাদ পাই আমরা। গায়ে আগুন লাগিয়েছিল। লোকজন জিজ্ঞেস করায় বারবার বলেছে বরের কোনো দোষ নেই, স্বেচ্ছায় গায়ে আগুন লাগিয়েছিল সে। কেন তার এরকম ইচ্ছে হল?
আমার দাদা রূপকলাকেন্দ্রের প্রাক্তন ছাত্র। আমাদের বাড়িতে এসে থাকে মাঝেসাঝে। একদিন রাতের বেলায় এসে বলে যে ওই প্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রী তুঁতে খেয়ে নিয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি। সম্ভবত বাড়ির সাথে সুদীর্ঘ ঝামেলার ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নেয় সে। এই মেয়েটিও মারা যায় দু-একদিনের মধ্যেই। আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় খবর বের হয়। রূপকলাকেন্দ্রের কর্তৃপক্ষর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করছে তার বাড়ির লোকজন। বিপর্যস্ত আত্মীয়সস্বজন বন্ধুবান্ধব পাড়া-প্রতিবেশীদের কথা খানিক পড়ি খবরের কাগজের পাতায়, খানিক দেখি দাদার মুখে আর খানিক মনে মনে আপনা থেকেই ভেসে ওঠে।
একই দিনে এই দুটো খবরই পাই। আর সেই দিনই সন্ধ্যেবেলা আমার এক সহপাঠীর ফোন আসে। আমার সেই সহপাঠীটি এসএফআই করে। সুদীপ্তর মারা যাওয়ার ঘটনাটা বিশদে বলতে শুরু করে ও। নিজের চোখে দেখেছে — গোলমাল ধাক্কাধাক্কির মধ্যেও কীভাবে ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেয়ে মাথায় চোট পায় সুদীপ্ত আর এরপরও কীভাবে পুলিশ ওর ওপরেও লাঠি চালায়। বিবরণীর শেষে আমায় মিছিলে যোগ দিতে ডাকে। আমার মাথা ততক্ষণে গুলিয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও মনে হয় ও কি আমায় এভাবে দলে টানবার চেষ্টা করছে? সংশয় হয় নানাবিধ, কিন্তু সমাধান হয় না কোনো।
কোথাও কোনো একটা বড়োসড়ো গোলমাল হচ্ছে, হয়েই চলেছে, যার আঁচ আমরা প্রত্যেকে নানা ভাবে নানা দিক দিয়ে পাচ্ছি। আমাদের জীবনযাপনে, রাজনীতিতে সর্বত্র একটা বড়ো গড়মিল, না মেলা হিসেব, না-নেওয়া সিদ্ধান্ত, হঠকারি উত্তেজনা রয়েছে। তার মোকাবিলা করা প্রয়োজন খুব শিগগিরি। আর কতজন বন্ধুকে আমরা এইভাবে চলে যেতে দেব?
Leave a Reply