নীতি
প্রিন্ট সংবাদমন্থনের প্রথম সংখ্যায় ‘কেন সংবাদমন্থন’ লিখে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এটা পাতি লোকের পাতি খবর দেওয়া নেওয়ার জায়গা। আর তা করতে গিয়েই যে পরিবেশ-পরিমণ্ডলের মধ্যে আমাদের থাকা, তারও খবর রাখা। ওয়েব সংবাদমন্থন এই স্পিরিট নিয়েই চলবে। রাজনৈতিক দলের ভেতরের বা বাইরের খবর, প্রশাসন-সরকারের খাসখবর, কর্পোরেটের সামাজিকতার খবরের জায়গা নয় ওয়েব সংবাদমন্থন। বড়ো মিডিয়ার বড়ো খবরেও সংবাদমন্থনের কোনো উৎসাহ নেই। আপন মতটি প্রকাশের খাতিরে বা কোনো মহতী আদর্শের অনুসারী বয়ান নির্মাণের জন্য ইতিউতি কিছু মানানসই তথ্য তুলে নিয়ে সাজিয়ে দেওয়াতেও ওয়েব সংবাদমন্থনের কোনো উৎসাহ নেই।
বরং ওয়েব সংবাদমন্থনের চরম উৎসাহ ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠ মানুষদের পূর্ণাঙ্গ বয়ান সংগ্রহ ও প্রকাশে। বড়ো গলা মানুষটির বদলে লাজুক ব্যক্তিটির কথাটি শুনতে ও শোনাতে। যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, সবচেয়ে টালমাটাল, অনিশ্চিত, অনির্দিষ্ট, এলোমেলো — তার বয়ানে সংবাদমন্থনের বেশি উৎসাহ। সংবাদমন্থনের উৎসাহ হকারের কাছ থেকে হকারি বা বেকারির কথার সাথেই তার ঠাকুরের পায়ে রোজ সকালে জবাফুল দেওয়ার কথাটিও শুনতে। ঠিকে কাজ করা মেয়েটার অপমানের সাথে সাথেই অভিমানের কথাটাও শুনতে। চাষির কাছে তার সঙ্কটের সাথে সাথেই তার কৃতিত্বের কথাটাও শুনতে। টোটোচালকের কাছ থেকে তার ইনকামের হিসেবের সঙ্গে সঙ্গে জীবনদর্শনের কথাটাও শুনতে। দুর্ভোগ আর ভোগ, সাহস আর ভয়, অন্যের হিতাকাঙ্খা আর স্বার্থচিন্তা, আনন্দ আর দুঃখ, প্রতিবাদ আর মেনে-মানিয়ে চলা — আটপৌরে মানুষদের এসমস্ত কিছুর খবরাখবরেই সংবাদমন্থনের সমান উৎসাহ।
ওয়েব সংবাদমন্থন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষটির রাগের চেয়ে একফোঁটা বেশি রাগতে, দুঃখিত মানুষটির দুঃখ ছাপিয়ে দুঃখী হতে, খুশি হয়ে ওঠা মানুষটির চেয়ে বেশি নাচতে উৎসাহী নয়। যে কোনো সচেতন উদ্যোগের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সমাজ ও মানুষের অভিভাবক হয়ে ওঠার ঝোঁক, মাতব্বরীর প্রবণতা। সংবাদমন্থন এ ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকতে চায়।
ওয়েব সংবাদমন্থন বিভেদকামীতায় উৎসাহী নয়, কিন্তু বিভাজনের বাস্তবতা এড়িয়ে যেতে চায় না, এবং ফারাক/তফাত/বিভিন্নতা ও তার প্রকাশে ভীষণ উৎসাহী। সংবাদমন্থনের মধ্যস্থতাকারী হওয়ার বাসনা নেই, প্রয়োজনে পক্ষপাতে এতটুকু লজ্জাও নেই। সংবাদমন্থন শত্রু খাড়া করায় উৎসাহী নয়, বৈরীতার নির্মাণের দিকে চোখ ফেলতে চায়। বৈরীতার নির্মাণকে শুধু কাঠামোয় না খুঁজে সামাজিক সম্পর্ক এবং সামাজিক ব্যক্তির মধ্যেও নজরটি দিতে চায়। তাই শত্রু চেনানো ছবি/ভিডিও/অডিও/লেখা/শিরোনামের জায়গা নয় ওয়েব সংবাদমন্থন।
কুশীলব
ওয়েব সংবাদমন্থনের সংগঠনে সকলেই প্রাথমিকভাবে প্রতিবেদক। ওয়েব সংবাদমন্থনের প্রতিবেদকরা যতটা না লেখক, তার থেকে বেশি বর্ণনাকারী, আর তার থেকেও বেশি সংগ্রাহক। অনেক সময়ই সে কেবলমাত্র অডিও ফাইল ট্র্যান্সক্রিপ্ট করে, খবরটি প্রকাশিত হলে লোককে জানায়, পড়তে বলে, মতামত দিতে বলে লেখাটির কমেন্ট সেকশনে। কিন্তু ঘটনার কাছে বা আটপৌরে মানুষটির কাছে পৌঁছে যাওয়া বা তাকে আবিষ্কার করা, দেখা, শোনা, ঘটনা বা ব্যক্তির কাছে ফিরে ফিরে যাওয়া — এগুলিতে ওয়েব সংবাদমন্থনের প্রতিবেদকরা স্বাধীন, স্বতন্ত্র, সক্রিয়, সচেতন এবং একইসাথে স্বতস্ফুর্ত। ওয়েব সংবাদমন্থনের প্রতিবেদকর অন্য হাজার কাজ কাছে, শখ-আহ্লাদ আছে, হয়ত শিল্পীসত্ত্বা আছে, হয়ত অ্যাকটিভিজম আছে, হয়ত রাজনীতি আছে বা নেই — কিন্তু তার সাথে সংবাদমন্থনের প্রতিবেদক সত্ত্বার কোনো বিরোধ নেই, বরং একে অন্যকে সাহায্য করে। এই প্রতিবেদকদের মধ্যেই কেউ কেউ সম্পাদক। সম্পাদকেরা ওয়েব সংবাদমন্থনে প্রতিবেদনগুলি প্রকাশের দায়িত্বপ্রাপ্ত। নির্দিষ্ট সময় অন্তর স্বনামে সম্পাদকীয় লিখতে পারে তারা। আর আছে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর — যেমন সব ওয়েবসাইটে থাকে, পূর্বনির্ধারিত কিছু দায়িত্ব নিয়ে, যার বেশিরভাগটাই টেকনিক্যাল।
======================
======================
২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি সংবাদমন্থনের প্রিন্ট ভার্সানের প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত
কেন সংবাদমন্থন
সমাজমঙ্গলের ভাবনা থেকেই সংবাদমন্থন পথচলা শুরু করতে চায়। তবে সমাজ কথাটা তো বেশ বড়ো একটা কথা। তাই এই পথচলার কাজকে একটু ভেঙে ভেঙে ঠিক করে নিতে হচ্ছে। সমাজের ভদ্রলোকেদের কথা, তথাকথিত শিক্ষিতসমাজের কথা, ক্ষমতাধরদের কথা, সরকার-পার্টি আর মাতব্বরদের কথা তো আমরা ঢের শুনেছি। সংবাদমন্থন এবার কিছুটা অন্যদিকে চোখ রাখতে চায়, অন্যত্র কান পাততে চায়।
সংবাদমন্থন প্রকাশ করতে চায় গ্রামের মধ্যেও প্রান্তিক আঁধার গ্রামের খবর; শহরের মধ্যে অলিগলি-ঘুপচি-শহরতলীর খবর; শ্রমিকের মধ্যেও যারা পেষিত — যারা অগণিত অথচ ‘প্রান্তিক’ বা ‘অসংগঠিত’ নামে পরিচিত তাদের খবর; পরিবারের মধ্যে মেয়েদের খবর — এমনকী বাচ্চাদের আর বয়স্ক বলে যারা বাতিল তাদের খবর। সংবাদমন্থন এসব খবরের দেওয়ানেওয়া করতে গিয়ে যে বিশ্বপ্রকৃতি ও পরিবেশ-পরিমণ্ডলের মধ্যে আমাদের ঠাঁই, অবশ্যই তার খবরও সমান তালেই রাখতে চায় — কারণ আমরা তো সেই প্রকৃতিরই সন্তান।
সংবাদমন্থন আপনাদের কেবল হাত গুটিয়ে থাকা পাঠক হিসেবেই চায় না। বরং যে নাড়া-ঘাঁটা, যে মন্থন আমাদের রোজকার জীবনের সঙ্গী, তাকে যদি কতকগুলো সাদা কাগজের ওপর অক্ষরে অক্ষরে সাজিয়ে ফেলি, তাহলে তো আমাদের ভোগ আর দুর্ভোগের সাক্ষী হতে পারেন আপনিও। এভাবে ট্রেনে-বাসে-পথে বা পাড়ায় ঘরে ফিরে আমাদের দু’দণ্ড অন্তরঙ্গ কথাবার্তার মধ্যে যুক্ত হতে পারে আরও অনেকে। বিশ্বজোড়া মাটির মানুষের এক রোজকার সংলাপ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে আমাদের এই ‘সংবাদমন্থন’।
আমরা ভেবেছি এবং আজও ভেবে চলেছি এমন এক সংবাদমাধ্যমের কথা, যা সমাজেরই অংশ, তাতে সংবাদদাতা ও পাঠক সকলের সমান অংশীদারি। পাঠক সেখান থেকে খবর নেয়, সেখানে খবর দেয়। তাই খবরকে কেন্দ্র করে কোনো ওপর থেকে চাপানো রাজনীতি বা প্যাঁচ সেখানে চলতে পারে না। খবরের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে আমাদের আটপৌরে অনুভুতি। কে জানে, সেই খবরাখবরের দু-একটা কখন কার কাজে লেগে যায়!
সাম্প্রতিক মন্তব্য