পশ্চিমবঙ্গের জৈবপ্রযুক্তি কাউন্সিলের গভর্নিং বডির সদস্য বিজ্ঞানী তুষার চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার, ৩০ জুন। পশ্চিমবঙ্গের নয়া জৈবপ্রযুক্তি নীতির খসড়া এখানে।#
একনজরে খসড়া (পশ্চিমবঙ্গ) জৈবপ্রযুক্তি নীতি ২০১২-১৩
- এ রাজ্যের বিশেষ জৈব-সম্পদ চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণ ও সহনশীল ব্যবহার
- জনস্বাস্থ্যে জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার করে সুলভে রোগনির্ণয় ও প্রতিরোধ
- জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণ প্রতিরোধ
- জৈবপ্রযুক্তি সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো
- জৈবপ্রযুক্তির জ্ঞানের ভিত্তিতে কৃষি-বাস্তুতান্ত্রিক চর্চাকে মদত দেওয়া
- ২০০৯ সালের রাজ্য কৃষি বিষয়ক কমিশনের পরামর্শ মেনে অবাঞ্ছিত জিন-খাদ্য ও জিন-শস্যের বদলে বিকল্পের সন্ধান
- জৈব-সার, জৈব-কীটনাশক সহ কৃষি সহায়ক বন্দোবস্ত
- দূষণহীন, পরিবেশ সহায়ক সবুজ রসায়নে সাহায্য
সরকারি জৈবপ্রযুক্তি নীতি
আমাদের কোনও জৈবপ্রযুক্তি মন্ত্রক নেই। এটি একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিষয়। কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের অধীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তর (ডিএসটি) প্রথম এই ব্যাপারে নজর দেয়। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি-র বিষয়গুলির মধ্যে এমন অনেক ছিল, যা রাজ্যের অধীন, যেমন কৃষি, স্বাস্থ্য, শিল্প প্রভৃতি। কাজেই শুধু জাতীয় নীতি দিয়ে এটা হবে না। রাজ্যস্তরেও একই রকম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তর থাকা দরকার। তাই কেন্দ্রে যদিও একটা পৃথক মন্ত্রক গড়ে উঠল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে, রাজ্যস্তরে কিছু বডি তৈরি হল।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এমন জিনিস, যা একটি মন্ত্রকের মধ্যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে না। এটা অনেকটাই নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ জরুরি। নাহলে তার স্বাধীন বিকাশ হয় না। তাই এই বডিগুলির ফান্ড বা কোন খাতে কত টাকা খরচ করা হবে, তা যদি সরাসরি সরকার থেকে ঠিক হয়, তাহলে তা বিকৃতি আনতে বাধ্য। একটা স্বাধীন চলার বন্দোবস্ত তার থাকা দরকার। তাই ডিএসটি বা পরে জৈবপ্রযুক্তি দপ্তর (ডিবিটি) এর ফান্ডের বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হলো অরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ওপর। ফান্ড দেওয়ার যে মিটিংগুলো হয়, সেখানে সরকারের মনোনীত সদস্যটি বা মন্ত্রকের মনোনীত সদস্যটি থাকতে পারে না — এই হলো প্রাতিষ্ঠানিক বন্দোবস্ত। কেন্দ্রীয় স্তরে এবং রাজ্য স্তরে এটাই বন্দোবস্ত। এই বন্দোবস্ত যদি না থাকে, তাহলে এটা কাজ করতে পারে না। তবে রাজ্যস্তরে সব জায়গায় ডিএসটি নেই। এখনও পাঁচ ছ’টি রাজ্যে ডিএসটি নেই।
আমাদের রাজ্যে ডিএসটি আছে, তাছাড়াও আছে স্টেট কাউন্সিল অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি। এই স্টেট কাউন্সিলে কোনও রাজনৈতিক লোক থাকে না। এখানে যারা থাকে তারা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি বা কোনও ব্যক্তি তার নিজস্ব কৃতিত্বে সেখানে আসতে পারে। কোন গবেষণা কত ফান্ড পাবে, তার বিচার বন্দোবস্ত এদের মাধ্যমেই হওয়া নিয়ম। আমাদের রাজ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক আছে, তার অধীনে স্টেট কাউন্সিল আছে, এবং তাদের আলাদা বাজেট আছে। জৈবপ্রযুক্তি দপ্তর বা ডিবিটি-ও এই প্যাটার্নেই আছে জাতীয় স্তরে। রাজ্যস্তরে নেই।
ডিএসটি থেকে কেউ যখন কোনও প্রজেক্ট বা প্রকল্প পায়, সেটার বৈজ্ঞানিক দর কতটা, তার নিরীক্ষা হয় অনেকটা। কিন্তু ডিবিটি-তে এভাবে হয় না। ওখানে রাজনৈতিক খববরদারি অনেকটা কাজ করে। ওখানে ব্যবসায়িক (ইন্ডাস্ট্রিয়াল) স্বার্থ বেশি পরিমাণে কাজ করে। আর জাতীয় স্তরে তাও একটা ডিবিটি থাকলেও রাজ্যস্তরে কিন্তু কোনও জৈবপ্রযুক্তি মন্ত্রক নেই। কিন্তু একটা সূচনা হয়েছে বলা যায়, এবং সেটা হয়েছে টেকনিক্যাল এডুকেশন বা প্রযুক্তি শিক্ষণ বিভাগের মধ্যে দিয়ে। এখানে প্রযুক্তি শিক্ষা মন্ত্রকের তৎপরতায় একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্টেট কাউন্সিলের মতো একটা জৈবপ্রযুক্তি স্টেট কাউন্সিলও হয়েছে। তারই গভর্নিং বডির সদস্য হওয়ার সুবাদেই আমরা রাজ্যস্তরে একটা জৈবপ্রযুক্তি নীতির খসড়া বানাতে পেরেছি।
তবে এরাজ্যে এখনও জৈবপ্রযুক্তির পূর্ণ মন্ত্রক নেই। পূর্ণাঙ্গ বাজেট নেই। অতএব এখনও অবদি এটা একটা সুপ্ত অবস্থাতেই আছে বলা যায়।
পশ্চিমবঙ্গে জৈবপ্রযুক্তি নীতিমালা তৈরির ইতিহাস
২০০২ সালে এরাজ্যে একটি জৈবপ্রযুক্তি মন্ত্রক বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। তখনই এখানে একটা জৈবপ্রযুক্তি নীতি বানানো হয়েছিল। তখন যেটা করা হয়েছিল, সেটা যে খুব ভালো একটা নীতি ছিল, তা বলা যায় না। সেকেলে টাইপের ছিল ওটা। তো ২০০৮ সালে ওটাকে পাল্টে একটা নতুন জৈবপ্রযুক্তি নীতি বানানোর তোড়জোর করেছিল বামফ্রন্ট সরকার।
এই ব্যাপারগুলো আমার জানা ছিল না আগে। কারণ কখনও এই ব্যাপারগুলো পাবলিকের কাছে আনাও হয়নি, এবং আলোচনাও করা হয়নি। আমরা সংবাদপত্রে দেখে চুচুঁড়ায় গিয়ে জিন-ধানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলাম। ওখানে জিন-ধানের ‘ফিল্ড ট্রায়াল’ বা মাঠ-পরীক্ষা করা হচ্ছিল। আমরা ওখানে যেমন বিক্ষোভ দেখিয়েছিলাম, তেমনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে যেহেতু হয়েছিল, তাই আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গেও দেখা করি। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ওটা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তখনও আমরা জানতে পারিনি যে একটা জৈবপ্রযুক্তি নীতি নতুন করে বানানো হচ্ছে।
তারপর সরকার বদল হওয়ার পর নয়া জৈবপ্রযুক্তি নীতি বানানোর বিষয়টা আমরা জানতে পারি। আমি ওটাতে সামিল হই এই কারণেই, যাতে এই যে খোলা মাঠে যে জিন-শস্যের পরীক্ষা বা ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছে, সেগুলির বিষয়ে নতুন নীতিটি একটা সুচিন্তিত ব্যবস্থা নিতে পারে। তখন আমরা দেখতে পেলাম, ২০০৮ সালে একটা জৈবপ্রযুক্তি নীতির খসড়া বানানো হয়েছে, যেটি ভীষণভাবে স্ববিরোধী। দেখতে পেলাম, বামফ্রন্ট সরকার ফিল্ড ট্রায়াল এবং অন্যান্য জিন-শস্যের বিপজ্জনক দিকগুলোকে ওই নীতির মধ্যে জায়গাও দিয়েছিল। মুখে যদিও ওরা তা কখনও স্বীকার করেনি। এবং এগুলো সিপিএমের একচ্ছত্র, অন্যান্য বাম পার্টিগুলোর সঙ্গে আলোচনাও করেনি। মোদ্দা কথায় ওই নীতিতে জিন-শস্যকে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়েছিল।
ওই বাম সরকারের আমলেই একটু আগে রথীনবাবুকে দিয়ে একটা কৃষি কমিশন করা হয়েছিল। উনি আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে একটা বিশাল রিপোর্ট বানিয়েছিলেন। প্রায় ছ’শ পাতার। ওটা বই হিসেবে বারও হয়েছিল। কিন্তু সরকার ওটা নিয়ে কী করবে তা কখনওই স্পষ্ট করেনি। লোকেও ওটা জানতে পারেনি। মন্ত্রকের মধ্যেও ওটা নিয়ে আলোচনা করেনি। বকলমে যেটা হয়, ওটার জন্য রথিনবাবু অত্যন্ত ধিকৃত হতে থাকেন। যেহেতু ওটাতে উনি জিন-শস্যর বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ওই রিপোর্টে, তাই ওনাকে বলা হয়, উনি বিজ্ঞান বিরোধী। আমি এই প্রক্রিয়াতে ঢুকে ব্যাপারগুলো জানতে পারলাম।
আমরা সাকুল্যে চারদিন সময় পেয়েছিলাম নতুন একটি নীতির খসড়া বানানোর জন্য। আমরা ঠিক করেছিলাম, নীতিটা খুব ছোটো রাখব, তাতে মৌলিক নীতিগুলো থাকবে। আগের নীতিটি ছিল বেশ বড়ো। তাতে আমাদের যে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, সেগুলোর অধিকর্তাদের একটু খুশি করার চেষ্টা ছিল। উদ্দেশ্য ছিল, একটা লবি তৈরি করা। যারা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে কাজ করবে। লবির একটা ভূমিকা থাকতেই পারে। কিন্তু নীতিমালাটাই যদি হয়ে যায় লবিমালা তাহলে মুশকিল। এমনকি জাতীয় নীতিতেও এ চেষ্টা ছিল না।
কর্পোরেট ও লবির স্বার্থ
আসলে আইএএস এবং আমলা স্তরে জৈবপ্রযুক্তিতে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষার জন্য একটা পুরো অলিখিত একটা নির্দেশ আছে। যেটা ডিএসটি-র ক্ষেত্রে সাধারণত ঘটে না। কিন্তু ডিবিটি-র মধ্যে ঘটে। ওটার মধ্যে কর্পোরেট এবং লবির স্বার্থরক্ষার চেষ্টা প্রচুর। যেমন আমার ধারণা, আইসিএআর (ভারতীয় কৃষি গবেষণা পর্ষদ)-ও পুরো মাথা নুইয়ে দিয়েছে এখন। আইসিএমআর (ভারতীয় মেডিক্যাল গবেষণা পর্ষদ) ও প্রায় তাই। সিএসআইআর-ও সেদিকেই যেতে বসেছে। তাও আমি বলব, ডিএসটি বা পরিবেশ মন্ত্রক এখনও একটু ছোটো ছোটো বলে এর মধ্যে আমলারাও এখনও কিছুটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। অন্যান্য সব বডিগুলিতে এমন ধরণের লোককে ডেকে ডেকে বসানো হচ্ছে, যারা একেবারে লবির লোক। সেটা আমরা এই রাজ্যের জৈবপ্রযুক্তি নীতি তৈরি করতে গিয়েও বুঝলাম। কারণ যখন আমরা এটা করলাম, সেটাকে অনেক দেরি করিয়ে দেওয়া হল (প্রায় নব্বই দিন, কোনও কারণ ছাড়াই)। এই দেরি করানোর কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, কেউ কেউ চাইছিল, এরই মধ্যে যদি কিছু কেন্দ্রীয় নীতি কার্যকর হয়ে যায়। যাই হোক, আমাদের মন্ত্রী যিনি, তার একটা সদিচ্ছা থাকায় এবং বাস্তববুদ্ধি থাকায় কিছুটা সাহায্য হয়েছে। উনি খসড়া নীতিটাকে ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। যাতে অন্যান্য রাজ্যগুলিও জানতে পারে, আমরা কি করছি। আগের পলিসিগুলো যখন তৈরি করা হয়েছিল, তখন এগুলো করা হয়নি।
ব্রাই বিল
জাতীয় স্তরে জৈবপ্রযুক্তি নীতি করা হলেও, যেহেতু এর মধ্যে কৃষি, স্বাস্থ্য প্রভৃতি রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয় আছে, তাই রাজ্যগুলি এ বিষয়ে তাদের ভূমিকা বজায় রাখবে। আজকে যখন কেন্দ্রের ব্রাই বিল (ভারতের জৈবপ্রযুক্তি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিল) নিয়ে কথা উঠছে, তখনও আমরা এই কথাগুলি বলেছি। রাজ্যগুলির অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকবে জৈবপ্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করার, নীতি প্রণয়ন করার। যদি প্রতিটি রাজ্যই এটা বলে, তাহলে ব্রাই বিল যেভাবে পাস করাতে চাইছে কেন্দ্র, তা হবে না। তবে অন্যান্য রাজ্যগুলি সেটা করুক বা না করুক, ব্রাই বিল আইনগতভাবেই অসঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু শেষ বিচারে প্রতিবাদ না করলে কোনকিছুই তো সেভাবে কাজ করে না। আইনটাও কাজ করবে না।
Leave a Reply