” |
এরা ডিরেক্টর, ম্যানেজিং কমিটির লোকেদের তুলনায় এদের দায় কম |
কলকাতা হাইকোর্টের বেঞ্চ, দুই মালিকের জামিন মঞ্জুর করে, ২৮ মার্চ ২০১২ |
” |
যারা হাসপাতালের দৈনন্দিন কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত নয়, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক |
বণিকসভা ফিকির বিবৃতি, ডিসেম্বর ২০১১ |
শমীক সরকার, কলকাতা, ৯ ডিসেম্বর#
আমরি অগ্নিকাণ্ডের একবছর অতিক্রান্ত হওয়ার অনেক আগেই ওই গণমৃত্যুর জন্য দায়ী কর্পোরেট আমরি হাসপাতালের মালিক ও ম্যানেজাররা সবাই জামিন পেয়ে গেছে কলকাতা হাইকোর্ট থেকে। গত বছর ডিসেম্বর মাসের ৯ তারিখে ওই অগ্নিকাণ্ডে আগুনে পুড়ে কেউ মারা যায়নি, ৯৪ জন মারা গেছিল দমবন্ধ হয়ে। আগুনের সাথে সাথে বিষ ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল হাসপাতাল। এয়ারকন্ডিশনারের কারণে ছিদ্রটুকু না রাখা এই হাসপাতালের বিল্ডিং থেকে সেই বিষ ধোঁয়া বেরিয়ে বাতাসে মিশে যেতে পারেনি। নিচের কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে দেওয়ার ফলে নিচে নেমে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল না। কিছু রোগী এবং স্টাফদের উদ্ধার করেছিল লাগোয়া বসতির যুবকেরা, মই বানিয়ে উঠে হাসপাতালের কাঁচের খাঁচা ভেঙে। কেউ কেউ ঝাঁপ দিয়েও বেঁচেছিল।
হাসপাতালের নিচের তলায় বর্জ্য পরিষ্কার না করা, অগ্নি নির্বাপনের যথাযথ বন্দোবস্ত না রাখা, বিষ ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার মতো ব্যবস্থা না রাখা — এইসব নীতিগত গাফিলতির দায় মালিকদের তথা গভর্নিং বডির, যা প্রতি তিন মাসে একবার করে বসে। আর হাসপাতালের দৈনিক কাজকর্ম পরিচালনা করে ম্যানেজিং কমিটি, যারা বসে প্রতি শনিবার। অগ্নিকাণ্ডের ফলে বিষ ধোঁয়ায় এতগুলি অসহায় মানুষের মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, ম্যানেজিং কমিটির কিছু কিছু দোষ থাকলেও (যেমন, আগুন লাগলে দমকলকে ঠিক সময়ে খবর দেওয়া প্রভৃতি) মূল অপরাধের দায় থেকে গভর্নিং বডি তথা মালিকরা কিছুতেই অব্যাহতি পেতে পারে না। তাদের গাফিলতি অথবা অবহেলাতেই এইসব কিছুই ঠিকঠাক ছিল না। তার জন্যই এই মৃত্যু মিছিল। এমনকি ম্যানেজিং কমিটি ঠিকঠাক কাজ করছে কি না তা-ও মালিকদেরই তো দেখার কথা! তারা তা দেখেও থাকেন! ২০১১ সালেরই অক্টোবর মাসে একটি আগুন লাগার ঘটনা ঘটলে এক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মী দমকলকে খবর দিয়েছিল। বিনিময়ে সে সাসপেন্ড হয়ে যায়! অথচ একের পর এক গভর্নিং বডির সদস্য পরপর জামিন পেতে থাকল, তাদের দায় কম — এই কারণে।
প্রথম একটি ট্রায়াল কোর্টে ২ ফেব্রুয়ারি জামিন পান অশীতিপর ডাক্তার মণি ছেত্রী, যিনি ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং আমরি হাসপাতালের লাইসেন্স যার নামে। ২৩ ফেব্রুয়ারি জামিন পান ডাক্তার প্রণব দাশগুপ্ত। ১৭ মার্চ জামিন পান হাসপাতালটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সত্যব্রত উপাধ্যায়, কারণ হিসেবে বলা হয়, উনি হাসপাতালটির সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাতে নেই। প্রসঙ্গত, এরা কেউই হাসপতালটির মালিক বা ম্যানেজার নন, কিন্তু হাসপাতাল পরিচালনার সাথে যুক্ত। প্রণব দাশগুপ্ত এবং মণি ছেত্রী বিখ্যাত ডাক্তার, এদের নামেই এই হাসপাতালটির ব্যবসা গড়ে উঠেছে তিলতিল করে।
এরপর শুরু হয় মালিক ও ম্যানেজারদের জামিন পাওয়া। ১৭ ফেব্রুয়ারি জামিন পান, মালিক-ডিরেক্টর আর এস আগ্রওয়াল। কারণ হিসেবে বলা হয়, তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ, গোটা ২০১১ জুড়ে কোনও গভর্নিং বডি মিটিং-এ তিনি ছিলেন না। কলকাতা হাইকোর্টের অসীম কুমার রায় এবং অসীম কুমার রয়ের বেঞ্চ ২৮ মার্চ আরও দুই মালিক তথা ডিরেক্টর এবং গভর্নিং বডি সদস্য আর এস গোয়েঙ্কা এবং প্রশান্ত গোয়েঙ্কার জামিন মঞ্জুর করার সময় মত ব্যক্ত করেন, এরা ডিরেক্টর, ম্যানেজিং কমিটির লোকেদের তুলনায় এদের দায় কম। ২ এপ্রিল জামিন মঞ্জুর করা হয় আরও দুই মালিক রবি টোডি এবং মনিশ গোয়েঙ্কার, কারণ হিসেবে বলা হয়, এরা গভর্নিং বডির সদস্য, হাসপাতালের রোজকার কাজের দায়িত্ব এদের নেই। ১০ এপ্রিল জামিন হয় একজিকিউটিভ ডিরেক্টর দয়ানন্দ আগরওয়াল এবং সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার সঞ্জীব পাল-এর। কারণ হিসেবে বলা হয়, একজন বাদে বাকি ডিরেক্টরদের জামিন হয়ে গেছে, তাই এদেরও জামিন দেওয়া হল। ওই একই বেঞ্চ ১২ এপ্রিল আরেক মালিক-ডিরেক্টর এস কে টোডি-র জামিন মঞ্জুর করে, চার্জশিট দেওয়া হয়ে গেছে এবং বিচার শেষ হতে অনেকদিন লাগবে, এই কারণে।
শেষজন হিসেবে ছাড়া পায়, অগ্নিকাণ্ডের রাতে আমরি হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সাজিদ হোসেন। এর আগেই ম্যানেজিং কমিটির সদস্য প্রীতি ব্যানার্জি জামিন পেয়েছেন। গভর্নিং বডির অন্য তিন সদস্য রাহুল টোডি, প্রীতি সুরেখা এবং আদিত্য আগ্রওয়াল ফেরার। সব মিলিয়ে ১৬ জন মালিক, ম্যানেজার এবং পরিচালন সমিতির সদস্য, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল, তারা সবাই জেলের বাইরে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, আমরি অগ্নিকাণ্ডের দিনই গ্রেপ্তার হওয়া আমরির মালিক কর্পোরেট গোষ্ঠী ইমামি এবং শ্রাচি-র প্রতিনিধিরা যাতে ছাড়া পায়, তার জন্য তদ্বির শুরু করেছিল কর্পোরেটদের সংগঠনগুলি। এদের অন্যতম ণ্ণফিকি’ একটি বিবৃতি পর্যন্ত দিয়ে বলেছিল, ণ্ণযারা হাসপাতালের দৈনন্দিন কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত নয়, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক’, কার্যত যা লগ্নিকারী মালিকদের ছাড় দিয়ে ম্যানেজার এবং কর্মচারীদের ফাঁসানোর পক্ষেই সওয়াল করা। এই কর্পোরেট মালিক-ডিরেক্টরদের জামিন দেওয়ানোর জন্য নিযুক্ত হয়েছিল দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উকিলরা। যেমন এস কে টোডির হয়ে সওয়াল করার জন্য উড়িয়ে আনা হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের বর্ষীয়ান উকিল রঞ্জিত কুমার এবং অভিমন্যু ভাণ্ডারীকে।
উল্লেখ্য, মণি ছেত্রী বাদে বাকি অভিযুক্তের জামিনের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার।
Leave a Reply