নিরুপম ভট্টাচার্য, রানাঘাট, ৩১ মার্চ#
২০০৭ সালের ১৪ মার্চ। আর ২০১৫ সালের ১৪ মার্চ। কাকতালীয় ভাবেই মিলিয়ে দেয় নন্দীগ্রাম আর রানাঘাটের ঘটনাকে। না। আপাতদৃষ্টিতে দুটি ঘটনার বিষয় প্রেক্ষাপট আলাদা হলেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দুটি জায়গাতেই সহাবস্থান করছে। কীভাবে? কেমন করে? আসুন এই বিষয়ে আলোকপাত করা যাক।
২০১৫ সালের ১৪ মার্চ শুক্রবার গভীর রাতে গাঙনাপুর থানার অধীনস্থ রানাঘাট মহকুমায় অবস্থিত কনভেন্ট জেশাস অব মেরি স্কুলে ডাকাতি ও নারকীয়ভাবে সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণের ঘটনা টেলিভিশন ও দৈনিক খবরের কাগজের মাধ্যমে পৃথিবীর কোনায় কোনায় পৌঁছে যায়। তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয় পৃথিবী জুড়ে। রানাঘাট হয়ে যায় আন্তর্জাতিক কলঙ্কের পীঠস্থান। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী অনতিবিলম্বে সিআইডি নামক তদন্তকারী সংস্থাকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
পাশাপাশি প্রতিবাদের ভাষা বাড়ে তীব্রভাবে। স্কুল ছাত্র থেকে ডন বস্কো পাড়ার মানুষজন রানাঘাট সহ কৃষ্ণনগর শান্তিপুর কল্যাণী কলকাতার প্রতিবাদী মানুষেরাও সংখ্যায় বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। শুরু হয়ে যায় ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে, ‘নো পলিটিক্যাল ফ্ল্যাগ’-এর ব্যানারে এক অরাজনৈতিক নাগরিক আন্দোলন। দেশবিদেশ থেকে আসতে থাকে মানুষেরা। মুখ্যমন্ত্রী আসেন সতেরোই মার্চ। সেদিনই খ্রিস্টান মিশনারির আহ্বানে বিকেল পাঁচটায় মোমবাতি সহযোগে এক মৌন মিছিলে নীরব প্রতিবাদ শুরু হয়। সন্ন্যাসিনীকে দেখে হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কে প্রতিবাদীদের সম্মুখীন হন মুখ্যমন্ত্রী। নীরব প্রতিবাদীরা তাঁর কাছে সুবিচার প্রার্থনা করে ‘শান্তভাবে’। কিন্তু পুলিশবেষ্টিত কনভয় থেকে উত্তেজিত ভাবে মুখ্যমন্ত্রী দেগে দেন — প্রতিবাদীরা বিজেপি, সিপিএম। চক্রান্ত করে তাঁকে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। তিনি আন্দোলনের লোক। যতক্ষণ খুশি বিক্ষোভ হোক, তিনি বসে থাকবেন। কিন্তু পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই আচম্বিত শাসক দলের কর্মীদের বন্দেমাতরম স্লোগান আর মমতা ব্যানার্জি জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে তিনি রানাঘাট থেকে চলে আসেন।
এরপর প্রতিবাদীদের ভাষা তীব্র হয়। পরদিনই, অর্থাৎ মঙ্গলবার গড়ে ওঠে রানাঘাট প্রতিবাদী মঞ্চ। শুরু হয় ধরনা। ধরনাকারীদের থেকে দাবি ওঠে, যতক্ষণ না আসামীরা শাস্তি পাচ্ছে, চলবে অরাজনৈতিক ধরনা। কিন্তু ধরনাকারীরা যেহেতু সংগঠিত নয়, তাই সুকৌশলে পুলিশের সহযোগিতায় ধরনাকারীদের অস্থায়ী প্যান্ডেল ভেঙে দেওয়া হয়। তবুও ধরনাকারীরা দাবি তোলে, খোলা আকাশে — উই ওয়ান্ট জাস্টিস। নো পলিটিক্যাল ফ্ল্যাগ। ধরনা চলে পাঁচদিন। আর এই পাঁচদিনের মধ্যেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বাড়তে থাকে নীরবে, সুকৌশলে। নীরব প্রতিবাদীদের চিহ্নিত করে বাড়িতে বাড়িতে চলে শাসানি ধমকানি। এখানেই মিলে যায় নন্দীগ্রাম আর রানাঘাট। সংগঠনহীন প্রতিবাদীরা ভয় পায়। টিভি খবরের কাগজ থেকে জানা যায়, যারা নাকি মুখ্যমন্ত্রীকে ‘ঘেরাও’ করেছিলেন এবং নিয়মিত নীরব প্রতিবাদ করছেন, তাদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় এফআইআর করেছে পুলিশ। বাধ্য হয়েই প্রতিবাদীরা ধরনা সমাপ্ত করে এবং ভীত হয়ে অনেকেই রানাঘাট ছাড়ে। রানাঘাটময় যে আতঙ্ক আজও বর্তমান, যার ফলে প্রতিবাদীরা অতি প্রয়োজন ছাড়া রাস্তাঘাটে বেরোতে ভয় পাচ্ছে, ফোন করতে বা ফোন ধরতে যথেষ্ট ভীত।
এরই মধ্যে এপিডিআর রানাঘাট পৌরসভা সন্নিকটে সরকার লজে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিবাদে কনভেনশন করে আঠাশে মার্চ শনিবার। আর তিরিশে মার্চ রানাঘাটে বুদ্ধিজীবী মানুষেরা এই সরকার লজেই গড়ে তোলেন এক প্রতিবাদী মঞ্চ (এখনও স্থায়ী নাম ঠিক হয়নি), যাদের কাজ হবে পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে শাসক দলের চোখরাঙানির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণ আন্দোলন গড়ে তোলা। যাতে পুলিশি অত্যাচার থেকে রক্ষা পায় নামগোত্রহীন নীরব প্রতিবাদী মুখেরা।
জানি না, ‘বদলা নয় বদল’-এর সরকার নীরব প্রতিবাদীদের ওপর শেষ পর্যন্ত বদলা নেবেন কিনা। শুনছি, পৌরসভা ভোট মিটতেই বদলা নেওয়ার কর্মকাণ্ড শুরু হবে।
Leave a Reply