প্রণয় দে, শান্তিপুর. ১৫ ফেব্রুয়ারি#
শরীর খারাপ হলে আমরা ডাক্তারের কাছে যাই নিরাময়ের কারণে, দৈনন্দিন যান্ত্রিক জীবনে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি খারাপ হলে বা হারিয়ে গেলে রাতের ঘুম কাবার। কিন্তু মনের অসুস্থতাকে আমরা ক-জন পাত্তা দিই? প্রায় নিজের দেহকে জানার মতো ক্রমশ আত্মমুখী ক্রমশ ব্যস্ত মানুষের কাছে মন বলে বস্তুটি কি মিলিয়ে যাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই শান্তিপুরের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক পীঠস্থান ‘সাহিত্য পরিষদ’-এ একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হয়েছিল, ৮ ফেব্রুয়রি রবিবাসরীয় বিকেলে। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট মনোবিদ মোহিত রণদীপ। বেশ কয়েকজন মানুষের উপস্থিতি, বিশেষত অল্পবয়সিদের চোখে পড়ছিল। প্রসঙ্গত, সাহিত্য পরিষদ শান্তিপুরের একটি প্রাচীন গ্রন্থাগার। বহু দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ আছে এই সংগ্রহশালায়।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে কতখানি সময় মনকে নিয়ে ভাবি এই প্রশ্নটিই এই আলোচনাচক্রে উঠে আসছিল। মোহিতবাবু বলেন, ‘কারোর ক্যানসার হলে সে বলে আমার ক্যানসার হয়েছে, কিন্তু কারোর মনের রোগ হলে কেউ কি বলে তার মনের রোগ হয়েছে?’ বস্তুত সকলেই একমত হয়েছেন এই প্রসঙ্গে। কিন্তু আমরা কীভাবে বুঝব মনের সমস্যা হয়েছে? আলোচনায় বিভিন্ন মত উঠে এসেছে। কেউ বলেছেন, কোনো কিছুতেই আগ্রহ পাওয়া যায় না, কেউ আবার বললেন যে তাঁর সব কিছুতেই মনে হয় ভেঙে ফেলে দিই। মোহিতবাবু এটিকে মূলত দু-টি ভাগে ভাগ করেছেন। আচরণগত সমস্যা, টেনশন — তাঁর মতে এগুলি মনের অস্বাভাবিক অবস্থা হতে পারে। আচরণগত বলতে গিয়ে তিনি বুঝিয়েছেন ১৫-১৮ বয়সি ছেলেমেয়েদের। কৈশোর ও যৌবনের যুগসন্ধিক্ষণের এই বয়সিদের মধ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। এই সময়টা তারা এমন একটা স্তরে থাকে যে তাদেরকে না পূর্ণবয়স্ক না অপূর্ণবয়স্ক, কোনোটাই বলা যায় না।
কথায় কথায় উঠে আসে আত্মহত্যার প্রসঙ্গ। সাম্প্রতিককালে আমাদের রাজ্যে আত্মহত্যার হার খুব বেশি। কিন্তু কেন? ‘মানুষের মন সরলরেখায় চলে না, কখনো তা উচুঁতে কখনো নিচুতে তার গমন। এই অধোগমন তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।’ কিন্তু এর কি কোনো সমাধানের পথ নেই? ‘অবশ্যই আছে, আমাদের প্রথমেই অগ্রাধিকার দিতে হবে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ, আত্মহত্যা না তার এই মহামূল্যমান জীবন। প্রত্যেক রাতের শেষে কিন্তু ভোর আসে’। আর এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মোহিত বলেন, মা বাবা আত্মীয়-স্বজন, অভিভাবক প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে, তাঁরা এমন কিছু বলে না বসেন যাতে সেটি এই প্রকার ঘটনা ঘটাতে পারে। এই প্রসঙ্গে পরিষদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সুশান্ত মঠ বলেছেন, আমরা পরবর্তীতে কীভাবে ভালো অভিভাবক হওয়া যায়, তার একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করব।
টেনশন বা উদ্বেগজনিত কারণ নিয়ে বলতে গিয়ে মোহিতবাবুর বক্তব্য, যখন টেনশন বা উদ্বেগ হচ্ছে তখন সেটিকে দমন করা উচিত নয়। এতেও কাজ না হলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত বলে তাঁর মন্তব্য। এই কথোপকথনে আরেকটি বিষয় চলে আসছিল, যেটি খুব মূল্যবান। হয়তো কারোর ব্যবহারে বা আচরণে আমরা বিস্ময় প্রকাশ করি অথবা ব্যঙ্গ করি, কিন্তু তার দিক দিয়ে ভাবলে বোঝা যায় কেন সে এই রকম আচরণ করছে। মোহিতবাবুর মতে, অন্যের অনুভূতিকে তার যায়গা দিয়ে দেখতে হবে, আরও মানবিক হতে হবে।
এই আলাপচরিতায় মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মনের কতটা যত্ন নিই এর উত্তর খোঁজা। এর উত্তর আদৌ পাওয়া গেল কিনা, পেলেও কতটা, সেটা সময় বলবে। তবে সকলের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তারা খুব প্রসন্ন। ওরা সকলেই চাইছিল, যাতে এই ধরনের অনুষ্ঠান আরও হয়। যেটি দেখে পরিষদ কর্তৃপক্ষ অনতিকালের মধ্যেই আরও এই প্রকার অনুষ্ঠান আয়োজন করবে বলে স্থির করেছে। চ্ছ্রআমরা খুবই আশাবাদী ও আনন্দিত, আজকের প্রতিক্রিয়া দেখে, আজকের এই সাফল্য আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা এই ধরনের অনুষ্ঠান আরও করতে চাই’, বলেছেন সুশান্তবাবু।
Leave a Reply