দীপংকর সরকার, কলকাতা, ঢাকুরিয়া, ছবি লেখকের তোলা#
কলকাতা থেকে হাওড়া জেলায় অবস্থিত আমতার দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিমি। সেখানেই বিখ্যাত জগৎমাতা মেলাইচণ্ডীর মন্দির অবস্থিত। হাওড়া স্টেশন থেকে সারাদিনে ৪-৫ বার আমতা যাতায়াত করে হাওড়া-আমতা লোকাল। বাংলার পুরোনো ইতিহাসের খোঁজে আর কৌতূহলী মনের টানে একদিন ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। হাওড়া থেকে সকাল ৬-২০ মিনিটের আমতা লোকালে চেপে বসলাম আপন খেয়ালে। সাঁতরাগাছির পর থেকে বাঁদিক হয়ে সিঙ্গল লাইনে ট্রেন চলছে। আর তখন থেকেই ট্রেনের জানলা দিয়ে বাংলার নৈসর্গিক গ্রামের দৃশ্যের ছড়াছড়ি। দুই ধারে ধান ও সরষের খেত। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আদিগন্ত উড়ে উড়ে যাচ্ছে। ট্রেন বেশ ফাঁকা। দেখতে দেখতে ৭.৪৫ মিনিট নাগাদ আমতা স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। স্টেশনে নেমে সামনের দিকে এগিয়ে ভ্যান রিক্সা ধরলাম। কিছুক্ষণ পর আমতা বাসস্ট্যান্ড পার হয়ে বাজারের কাছে এসে নামলাম। ডানদিকে সরু গলি হয়ে বাজারে এসে পৌঁছালাম। মা মেলাইচণ্ডীর মন্দিরের সামনেই জমজমাট বাজার। প্রচুর মানুষ বাজারে আসে, আসে চাষিরাও তাদের সবজি-ফল পাইকার দিতে। সকাল থেকেই এখানে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। আমতাবাসীর কাছে এই মন্দির অতি প্রিয়। বাজারের মধ্য দিয়েই মন্দিরে ঢোকা যায়, তার কিছুটা ডানদিকে শিবমন্দির। শ্রী অক্ষয় কুমার সাহা ১৩০৯ সালে এই মন্দিরের সংস্কার করেছিলেন, জানতে পারলাম মন্দিরের গায়ে ফলক দেখে।
মূল মন্দিরের মাঝখানে চাতাল ও উঁচু বেদিযুক্ত দুর্গা মণ্ডপ। একটু ঢুকে উপাসনা গৃহ। রামকৃষ্ণ মঠ দ্বারা নির্মিত। মন্দিরে ঢুকে সোজা মা মেলাইচণ্ডীর মূল মন্দির। প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে পুরোহিত দ্বারা পুজো হয়। মূল মন্দিরে তিনটি দ্বার অবস্থিত। আমতা মেলাই পাড়াবাসী ভক্তদের কাছে এটি অতি জাগ্রত মন্দির। বিভিন্ন উৎসবের দিনে এখানে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। মাঘ মাসে এখানে মেলা বসলে প্রচুর লোকসমাগম হয়। বুদ্ধ পূর্ণিমাতেও এখানে মেলা বসে। কথিত আছে জটাধারী চক্রবর্তী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন প্রায় তিনশো বছর আগে। লোকশ্রুতি আমতা মেলাইচণ্ডী একটি সতীপীঠ। প্রাচীন সতীপীঠের শব মাহাত্ব আছে। দেবীর পূর্ণাক্ষা রূপ নেই। মালাইচাকির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। দেবীর বাহু ও পদযুগল নেই। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন প্রতিষ্ঠা দিবস। দেবীর মন্দিরের বাঁ-পাশে দেবী দুর্গেশ্বরী। ভৈরবের পূজা হয়। আমতাবাসী হিন্দু ভক্তদের কাছে এই ভৈরব অতি জাগ্রত বলে খ্যাত। আমতাবাসীরা বলে, মেলাই মা আর স্থানীয় মানুষ বলে, জগৎমাতা। দুর্গোপুজার সময় এখানে মহোৎসব হয়। দেবী দুর্গা ও চণ্ডী উভয়েই পুজিত হন। দেবীর সঙ্গে ভৈরবকেও পুজা করা হয়।
বাংলার ঐতিহ্য ও লোকগাথা সমৃদ্ধ এই প্রাচীন মন্দির দেখতে গিয়ে যেন আমি হারিয়ে পড়ি ইতিহাসের সেই গহ্বরে, যেখানে মানুষ তাদের স্মৃতিকে রেখে গেছে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির মোড়কে। প্রতীকি ধর্মকে ঘিরে রয়েছে স্থানীয় সংস্কৃতি চর্চার মেলবন্ধন। বুদ্ধ পূর্ণিমার মেলা কিন্তু শুধু মেলাইমার ভক্তদেরই বাঁধেনি, বেঁধেছে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষকে। মিলিয়েছে তাদেরকে একে অপরের সুখ-দুঃখকে ভাগ করে নেওয়ার আনন্দে। এখানেই যেন মেলাইমা হয়ে ওঠেন প্রতিদিনের আমতাবাসী মানুষের হিত-অহিত ভালো-মন্দের সাক্ষী। আমিও যেন মাঝে মাঝে একাকী এই জাগ্রত দেব-দেবীর সাথে মিলিত হয়ে গ্রামবাংলার নানান প্রান্তের জীবন্ত ইতিহাসের বার্তাবাহক।
Leave a Reply