রেহানা বারোই, কোচবিহার, ১৪ আগস্ট#
ক্লাস শুরু হল, প্রতিদিনের মতো প্রথম শ্রেণীর নাম ডাকার পর হাতের লেখা জমা নেওয়ার পালা। সাগরি পরভীন প্রায় মাসখানেক পর স্কুলে এল। জিজ্ঞেস করলাম, খাতা কোথায়? উত্তর এল একটু অসহায়ভাবে, মোর খাতা নাই। বললাম, ও শ্যাষ হয়্যা গ্যাছে। তোমার আব্বা ক নয়া খাতা কিনি দিবার কইবেন? ‘মোর আব্বা বাড়িত নাই’।
এই গ্রামের ৭০ শতাংশ মহিলা ও পুরুষ বা ছাত্রছাত্রীদের বাবা মা উভয়েই পাকস্থলীর টানে দিল্লি যায় কাজ করতে। তাই ভেবে বল্লাম, কোটে গেইছে, দিল্লি? মেয়ের চোখে জল ছলছল। বলছে না কথা। আর একটি মেয়ে কুলসুম বলল, উয়ার আব্বা জেলোত। কোথাও একটা ছন্দের বিরতি ঘটল, কষ্ট হল মনে। সাগরিকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার আব্বা জেলোট ক্যানে মাও। বলল, নদী দিয়া গুয়্যা (সুপারি) পার কইরবার ধরছিল। সেলা পুলিশ ধরি নিয়ে গেছে। কুন পুলিশ? আমার এথাকারে পুলিশগুলা ধরি টাউনের জেলোত থুইছে। এখানকার পুলিশ মানে বিএসএফ। সীমান্তরক্ষী বাহিনী। আর কথা না বলে, দুটো খাতা ও কলম এনে সাগরিকে দিলাম।
টিফিনের সময় সাগরির বড়োভাই আরবাজকে ডেকে বললাম, তোমার আব্বা বলে জেলোত? বলল, হিঁ। কদ্দিন হয়? একমাস। কী হইছিল মোক একনা খুলি কন তো বাপ। আরবাজ বলল, ওর বাবা মা অনেক দিন ধরেই দিল্লিতে কাজ করতে যায়।
এইবারই প্রথম সুপারির বস্তা ভারত থেকে বাংলাদেশে পার করবার ঝুঁকি নিয়েছিল। আর তার পরিবর্তে জুটেছে একপিঠ রবার বুলেট, আর জেলখানার বন্দী জীবন।
আরবাজের মুখে একটা কথা শুনে অবাক হলাম। যে রবার বুলেটও শরীর ফুঁড়ে ঢুকে যায়। রক্ত ঝরায়। ও বলল, আব্বার যে জামাটা পিন্দি গেইছে, গোটায় জামাটা রবারের গুলি ফুট্যা হইছে। আরবাজের বাবার দায়িত্ব ছিল শুধু এপার থেকে ওপার করা। তার বিনিময়ে কিছু টাকা পেত। আর যে মহাজনের সুপারি সে বাড়িতে দিব্বি সুখে আছে।
দিল্লিতে কাজ করার জমানো টাকা দিয়েই খানিক চলছিল। কিন্তু কতদিন আর চলে? ভাঁড়ারে টান পড়েছে। চতুর্থ শ্রেণীর ছেলে আরবাজ। ভোরবেলা উঠে পচা পাটের আঁশ ছাড়াও (কোষ্টা ধুবার যায়), আর তার বিনিময়ে মেলে শুধু ছাড়ানো পাটকাঠিগুলো। ন-টায় বাড়িতে ফিরে স্নান করে স্কুলে আসে। এখন ওদের পরিবারে উপার্জনের নিশ্চয়তা নেই। নেই খাবারের নিশ্চয়তাও। মিড ডে মিলের বেল বেজে উঠল। আরবাজ বলল, মুই খাবার যাং?
সকলের সাথে আরবাজও খেতে বসল। আর আমার ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রবার বুলেট ঢুকে যাওয়া একটা ঝলসে যাওয়া রক্তাক্ত পিঠের ছবি স্থির হয়ে রইল।
Leave a Reply