২৬ জুলাই, রঞ্জন#
৫ জুন পরিবেশ দিবসে তবু কিছু সরকারি বাদ্যবাজনা বেজেছিল। ১৪-২১ জুলাই অরণ্য সপ্তাহে তাদের সাড়াশব্দ মিলল না।
উৎসাহের ঘাটতি অবশ্য ছিল না একটুও, কামারহাটি পুরসভার পিছনে নিকাশি খাল বরাবর ছড়িয়ে থাকা রবীন্দ্রনগর কলোনির ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের। ৫ জুনের পর আবার ২১ জুলাই অরণ্য সপ্তাহের শেষদিনে গাছ লাগানো হবে শুনে ওদের মধ্যে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। গতবার যারা গাছ পায়নি, এবার তাদের দিতেই হবে, এমন দাবিও উঠল।
এদিকে ওদের পাড়ায় চওড়া গভীর নালা তৈরির কাজ প্রায় শেষ, অতএব পিছু পিছু এসে গেল বলে ১৬ ফুটের পাকা রাস্তা বানানোর সন্দেশও! আর তার মানেটাও কচিকাঁচারা সবাই এতদিনে জেনে গেছে। অনেকরকম গাছের ছায়ায় ঘেরা এই পল্লির সব গাছ কাটা পড়বে। এই খবরটা চাউর বলেই কি এবার বাড়িতেই গাছ লাগানোর উৎসাহে আরও টগবগ করছে তারা।
বয়স্করা যদিও নির্বিকারই বেশিরভাগ — হতাশা ঢাকেননি এই বলে যে সব গাছই কাটা পড়ে যাবে — বাঁচানো অসম্ভব। অমন পরিমণ্ডলেও তবু বিনা বাধায় গাছ কাটতে দেব না — এমনও বলেই ফেললেন এক মহিলা — জোর গলায় ক্ষোভ ঢেলে দিয়েই।
এভাবে এত সব গাছ কেটে দেবে, এটা আটকানো যায় না? গাছ কাটলে তো গাছ লাগানোরই কথা, লাগায় কই? ১৬ ফুট চওড়া রাস্তাই বা কী হবে আমাদের এখানে? কথাগুলো বলছিল সোমনাথ। ‘স্যার, কদমগাছটা কাটতে দেব না’, শুভর গলায় উত্তেজনা।
তিনদিন আগে থেকে ওরা প্রায় ১৫-২০ জন মিলে অরণ্য সপ্তাহ পালনের ঘোষণা ছাপানোর ছোটোখাটো পোস্টার সাঁটিয়ে পুরো পাড়াটাকে ভরে দিয়েছিল।২০ জুলাই সুমনা, মমতা, লক্ষ্মীরা বাসে চেপে ঘণ্টা দেড়েকের পথ পেরিয়ে গিয়েছিল সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কে। অনেক পরিশ্রম করে প্রচুর গাছ ভরতি ব্যাগ নিয়ে ফিরে এল।
২১ জুলাই বিকেল পাঁচটার পরে পাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তের ঝিলপাড়ে গাছের পায়ে ব্যানার লাগানো হল। ‘বাঁচতে হলে বাঁচব গাছ লাগিয়েই। গাছ বাদ করে? বাঁচতে নারাজ, বাঁচব না’।
হাতে হাতে গাছ নিয়ে সার সার দাঁড়াতেই ছবি তুললেন সোমনাথদা, রাজেশ মাটিতে চালাল শাবল, বেজে উঠল শাঁখ। কচি হাতগুলো পরম যত্নে মাটিতে গাছ বসিয়ে, মাটি চেপে দিয়ে, জল দিল। আর এইভাবেই চলল একের পর এক বাড়িতে কাঞ্চন, টেকোমা, বসন্তদূত, বাঁদরলাঠি, ফলসা, রিঠা, পেঁপে, বকুল গাছ পোঁতা। এবার আর বাসিন্দারা, বিশেষত মহিলারা পারল না ঘরে ঢুকে থাকতে। তারা গাছ চাইল, বলতে লাগল, কোনটা কোথায় বসাতে হবে। রাজেশ, সোমনাথ, শুভ শাবল চালাচ্ছে আর মামপি , পিয়ালি, পূজা, বাবাই, দীপকদের দলবলের উৎসাহে টগবগ করছে পল্লি। রাস্তা বানানোর কারণে গাছ কাটা পড়ার আশঙ্কায় বড়ো নিম বা কৃষ্ণচূড়া-বেল লাগানোই গেল না রাস্তার ধারে।
প্রায় ৩০টা গাছ পোঁতার পর ক্লাবঘরের সামনে দাঁড়িয়ে শুরু হল গান আর কবিতা আবৃত্তি। এরপর ছোটোবড়ো প্রায় পঞ্চাশজন মিলে শুরু হল পদযাত্রা। পথের দুপাশে বিলি করা হল লিফলেট। তাতে ছিল সড়ক বানাতে গিয়ে গাছ না-কাটার আবেদন। পুরসভার গেটে পৌঁছে শেষ হল অরণ্য সপ্তাহের কর্মসূচি।
Leave a Reply