মুহাম্মাদ হেলালউদ্দিন, কাশিপুর, পুরুলিয়া, ১৩ অক্টোবর#
ভারত সরকারের তফশিলি জনগোষ্ঠী সংরক্ষণের তালিকায় এক নম্বরে অসুর জনগোষ্ঠী। এরা সমস্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার হকদার। অথচ এই জনগোষ্ঠীকে বিকৃত করে শুধু ঘৃণিত ও নিন্দিত করা হচ্ছে না, তার হত্যালীলা প্রকাশ্যে প্রদর্শিতও হচ্ছে। তারই প্রতিবাদে মূলনিবাসী জনগোষ্ঠী রূপসী বাংলার বিভিন্ন জেলায় অসুর উৎসব পালন করছে। এবার ছিল তৃতীয় বছর।
অসুর উৎসবে আমরা দল বেঁধে কলকাতা থেকে পুরুলিয়া গিয়েছিলাম ১৩ অক্টোবর ২০১৩। পুরুলিয়ায় সাড়ম্বরে পালিত হল অসুর উৎসব। চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে হাওড়া থেকে প্রায় তিনশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আদ্রা থেকে দক্ষিণে ৬ কিমি, আদ্রার পরের স্টেশন আনাড়, সেখান থেকে কাশিপুর থানার অন্তর্গত ভালাগড়া গ্রাম। সেখান থেকে সোনাইজুড়ি হাইস্কুল মাঠে উৎসব।
এখানকার নবমীর দিন হুদুড়দুর্গা মহিষাসুরের (অসুর) স্মরণে মেতে ওঠেন সাঁওতাল, মুণ্ডা, কোল ও কুড়মী গোষ্ঠীর আদিবাসী মানুষজন। আয়োজক শিকর দিশম খেরওয়াল বীর লাকচার কমিটি।
অন্যতম উদ্যোক্তা চরিয়ান মাহাত জানান, তাঁদের বিশ্বাস, অসুর ছিলেন ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা অনার্যদের রাজা। আর্যরা সাম্রাজ্য বিস্তার করতে এসে তাঁকে হত্যা করে। কৌশলী আর্যরা অসুরের সঙ্গে যুদ্ধে এগিয়ে দিয়েছিল দুর্গাকে। নারী বলে অসুর তাঁকে আক্রমণ করেননি (কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে নারী-শিশু-বৃদ্ধকে আক্রমণ করা হয় না)। বিনাযুদ্ধেই মৃত্যুবরণ করেন অসুর। চরিয়ান আরও জানান, ‘আমরা মনে করি অসুর শহিদ হয়েছিলেন, তাই আমরা নবমীর দিন তাঁকে স্মরণ করে সভা করি।’
কমিটির সম্পাদক অজিত প্রসাদ হেমব্রম বলেন, আদিবাসীদের আদি পুরুষ হুদুড়দুর্গা ঘোড়াসুর তথা মহান রাজা মহিষাসুর বিদেশি আর্য রমনীর দ্বারা অন্যায়ভাবে নিধনের ফলে ভারতের ভূমিপুত্র আদিবাসী খেরওয়ালগণ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারিয়েছিল। হুদুড়দুর্গা তথা ঘোড়াসুরকে নীতিহীন যুদ্ধে পরাজিত করে আর্যসমাজ বিজয় উৎসবে মেতে ওঠে। চারদিন ধরে দুর্গার আরাধনা করে। আর আমরা রাজাকে হারানোর দুঃখ দাঁশাই ও কাঠি নাচের মাধ্যমে প্রকাশ করি। স্মরণের সময় অতি করুণ সুরে হায়রে হায়রে শব্দ যোগে দাঁশাই ও কাঠি নাচ করি। সাঁওতালী দাঁশাই-এর বিধি অনুসারে পাঁচদিন দেবী দুর্গার মুখ দর্শনে নিষেধ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যার অসুর সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী দুর্গাপুজোর সময় বাড়ি থেকে বেরোয় না।\par
অনার্য আদিবাসী মূল ভারতীয়দের মুখ্য দুর্গ পরিচালনা করেছিলেন মহানরাজা ঘোড়াসুর, তাই তাকে হুদুড় দুর্গা বলা হয়। হুদুড় দুর্গা স্মরণে উপস্থিত হন হাজার হাজার আদিবাসী মানুষজন। সাম্রাজ্যবাদী আর্যদের কাছে ঘোড়াসুর অশুভ হলেও সমগ্র ভারতের ভূমিপুত্র ৮৫ শতাংশ দলিত জনগোষ্ঠী তথা মূলনিবাসীদের কাছে তিনি পরম শুভ।
এই উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারকলিপি থেকে নিচের অংশটি উদ্ধৃত করা হল : ‘বাঙালিদের শারদীয়া দুর্গোৎসবের সময় ভারতের ভূমিপুত্র খেরওয়াল আদিবাসীদের মধ্যে, বিশেষত সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওরাং প্রভৃতি জাতির যুবকেরা আশ্বিনের ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত দিনগুলিতে বীরঙ্গনা নারীর মতো স্ত্রীবস্ত্র পরিধান পূর্ব্বক সেরেঞ বা ভুয়াং হাতে দলবদ্ধভাবে দাঁশাই নাচ করে থাকে। তেমনি অন্যদিকে কুড়মি কোবিলার জাতিগোষ্ঠী এবং কোড়া কোবিলার, বাউরী, সহিস, মুদি প্রভৃতি ভূমিপুত্র জাতিগোষ্ঠীর যুবকেরাও একইরকম ভাবে নারী বস্ত্র পরিধান করে দলবদ্ধ ভাবে কাঠি নাচ করতে করতে গ্রামগঞ্জে ভিক্ষা করে বেড়ায়। এক্ষেত্রে সাধারণ বাঙালি থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী বাঙালিরাও ভূমিপুত্র আদিবাসীদের এইরূপ দাঁশাই নাচকে তাদের দুর্গোৎসবের স্বপক্ষে আদিবাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বলেই মনে করে থাকে। এবং সেই কথা ভেবেই ইতিপূর্বে পত্রপত্রিকাতেও তারা সেইভাবেই সংবাদ পরিবেশন করেছে। কিন্তু এই নাচ ভারতের ভূমিপুত্রদের দুর্গা উৎসবের স্বপক্ষের বা আনন্দের নাচ নয়। এই নাচ দুর্গোৎসবের বিপক্ষের নাচ। …’
Leave a Reply