সাদ্দাম হোসেন, মশালডাঙা, কোচবিহার, ১৯ আগষ্ট ২০১৫#
[মশালডাঙা, পোয়াতুরকুঠি প্রভৃতি পূর্বতন ছিটমহল অধুনা কোচবিহারের অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলি থেকে যারা লিখছে, তারা আগে কোথাও কখনও কোনো লেখা বা রিপোর্ট লেখেনি। ছিটমহলের উচ্ছ্বাস তাদের ভাষাতেই বোঝার জন্য এই ধরনের বেশ কিছু রিপোর্ট বেরোবে। তার সাথেই থাকবে বাইরে থেকে যারা ওখানে যাচ্ছে, তাদের রিপোর্ট-ও]
সদ্যই, দিন পনেরো আগে, ১ আগষ্ট ২০১৫, বিজয় দিবসে স্বাধীনতার আনন্দে মেতে উঠেছিল ভারতের সঙ্গে নতুন সংযোজিত এলাকার নবভারতীয়রা। আর সেদিন ৩১ জুলাই রাতে মূল অনুষ্ঠান হয়েছিল এই মশালডাঙাতেই। নতুন সাজে সেজে ছিল মশালডাঙা, এলাকার বাসিন্দারাও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন নতুন জামাকাপড় পড়ে। ৩১ জুলাই ঘড়িতে রাত বারোটা বাজতেই মশালডাঙা আবির্ভুত নতুন রূপে। মশালডাঙার আকাশে উড়লো তেরঙা, তেরঙ্গার নিচে দাঁড়িয়ে এলাকাবাসী মন-প্রাণ উজার করে দিয়ে গায়ছেন জাতীয় সঙ্গীত। কমিটির শীর্ষনেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত উচ্চারণ করেছিলেন ‘বন্দমাতরম, ভারত মাতা কি জয়’। আকাশ রঙিন হয়েছিল রং বেরং-এর বাজি পটকায়। প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল বাড়ি বাড়ি ৬৮টি করে মোমবাতি আর মশাল প্রজ্বলনের। উল্লেখ্য, সেদিন পতাকা উত্তোলন করেছিলেন বিধায়ক শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয়।
মহান বিজয় দিবসের রেশ কাটতে না কাটতেই নবভারতীয়দের (ছিটমহলবাসীদের) জীবনের প্রথম স্বাধীনতা দিবস নিয়ে হাজির হয় ১৫ আগষ্ট। প্রথম স্বাধীনতা দিবসকে সাজাতে কয়েকদিন থেকেই তৎপর ছিলেন এলাকাবাসী। এদিন মশালডাঙায় নিজেদের তৈরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাণ, মাদ্রাসা, ক্লাব, নাগরিক অধিকার রক্ষা সমন্বয় কমিটির কার্যালয় ইত্যাদি সমস্ত জায়গায় উড়তে দেখা যায় ভারতের জাতীয় পতাকা। এছাড়া প্রচুর বাড়িতেও পতাকা উত্তোলন করা হয়। মশালডাঙার আকাশ রঙিন হয়ে ওঠে তেরঙায়। ‘দীঁপক সেনগুপ্ত স্মৃতি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র’-তে পতাকা তোলেন এলাকার সবচেয়ে প্রবীন বাসিন্দা ১০৬ বছর বয়সী আজগড় আলি। এরপর সমবেত কন্ঠে উচ্চারিত হয় জাতীয় সঙ্গীত। তারপরেই ‘বন্দেমাতরম’, ‘স্বাধীনতা দিবস কি জয়’, ‘ভারত মাতা কি জয়’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পরিবেশ। পতাকা উত্তোলন শেষে মিষ্টি মুখ করানো হয় এবং একটি ছোটো ও আলোকদিশারী বক্তব্য রাখেন সংগঠনের নেতা ও বিখ্যাত কার্টুনিষ্ট অনিরুদ্ধ পালিত। তিনি একসময়ে এই মশালডাঙাতেই গ্রামের মহিলা শাবানাকে দিয়ে চালু করেছিলেন একটি ছবি আঁকার স্কুল। কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়াই প্রাতিষ্ঠানিক শৈলীর বাইরের এক জগৎ থেকে তিনি যে শিল্প তুলে আনতে চাইছিলেন, তারই কিছুটা ঝলক দেখা গেল বসে আঁকো প্রতিযোগিতায়। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই কেন্দ্রকে এবারে বাড়াতে হবে। এটা হবে গ্রামীন শিল্পচর্চা কেন্দ্র। নক্সি কাঁথা, নক্সি পাখা তৈরির কাজে দক্ষ মহিলাদের নিয়ে একটা গোষ্ঠী বানিয়ে গ্রামীন অর্থনীতির একটা দিশা দেখানো যেতে পারে, যেটা পরবর্তীকালে অন্যান্য ছিটমহলগুলোতেও মডেল হিসেবে কাজ করবে।
ছিটমহলবাসির আন্দোলন ও বিজয়ের মুহুর্তের ছবি এবং একসময়ের আন্দোলনের হাতিয়ার কার্টুন-এর ছবি লাগানো হয় রাস্তায় রাস্তায়। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ১০৬ বছরের আজগড় আলি আবেগে আপ্লুত হয়ে যান এবং সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘সাতচল্লিশের স্বাধীনতা দেখেছি, এর পর একাত্তরের স্বাধীনতা দেখেছি, কিন্তু নিজে প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারিনি। এবারে সেই অপেক্ষার অবসান হল’।
বাত্রিগাছ ছিটমহলে প্রশাসনের দিক থেকে ছিটমহলবাসীর সাথে স্বাধীনতার দিনে যোগ দেন জেলাশাসক পি উলগানাথন, সঙ্গে ছিলেন পুলিশ সুপার রমেশ যাদব, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দেবর্ষি দত্ত, দিনহাটার মহকুমা শাসক কৃষ্ণাভ ঘোষ। জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার অভিনন্দন গ্রহণ করেন পুলিশের বিভিন্ন বিভাগের দিক থেকে। শিশুদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ ছাড়াও এলাকার তরুণ বাসিন্দা রৌশন সরকার, বিবেক কুমার রায়দের হাতে খেলার সাজসরঞ্ছাম তুলে দেন জেলাশাসক। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় উৎসব মুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো পালন করা ছিটমহলবাসীর স্বাধীনতার দিনটি অন্তরে আজীবন লিপিবদ্ধ থাকবে।
Leave a Reply