২৪ মার্চ, জিতেন নন্দী, কলকাতা#
২১ ও ২২ মার্চ কলকাতার গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশনের বিবেকানন্দ হলে ছিল নির্বাচন ও রাজনীতির সংস্কার নিয়ে ১১তম জাতীয় সম্মেলন। বিরাট আয়োজন, প্রচুর মানুষের সমাগম। তবে সবটার মধ্যেই আনুষ্ঠানিকতা আর ব্যয়বাহুল্যের দিকটা চোখে পড়ার মতো। সব মিলিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের মহিমা প্রকাশ!
ভারতের চিফ ইলেকশন কমিশনার এইচ এস ব্রহ্মের দীর্ঘ বক্তব্য থেকে জানা গেল, সারা পৃথিবীতে ২০৪টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৯৪টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের প্রতিনিধি স্থির করা হয়। আমাদের দেশে ১৯৫০ সালে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগেই নির্বাচন কমিশন তৈরি হয়েছে। দেশের ৩৬টা রাজ্যে মোট ১৬০০ রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে মোটামুটি ২০০টা দল নির্বাচনে লড়াই করে। মাত্র ৬টা জাতীয় দল আর বাকিগুলো আঞ্চলিক দল। তবে নির্বাচনে না লড়াই করলে কোনো দলের স্বীকৃতি রাখা যাবে কিনা; আবার নির্বাচনে কোনো প্রার্থী কমসংখ্যক ভোট পেলে তাকে ফের নির্বাচনে দাঁড়াতে দেওয়া যাবে কিনা, এসব নিয়ে সরকার ভাবছে। সরকার এটাও ভাবছে যে ভোটার কার্ডকে আধার কার্ডের নাম্বারের ভিত্তিতে দেওয়া হবে, যাতে লোকে সহজেই ভোটার কার্ড পেয়ে যায়, এমনকী ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও যাতে পাওয়া যায়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তো জানিয়েছে, আধার কার্ড করা বাধ্যতামূলক নয় এবং এখনও অনেকেই আধার কার্ড পায়নি — এ নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন তুললে শ্রী ব্রহ্ম জবাব দেন, ইতিমধ্যেই ৮৫,০০০ নাগরিককে আধার কার্ড দেওয়া হয়েছে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বাকিদের তা দেওয়া হবে।
আম আদমি পার্টি দিল্লির নির্বাচনে পার্টির খরচটা প্রকাশ করেনি
এরপর ছিল ভালো সরকার পরিচালনার জন্য রাজনীতিতে টাকা ঢালার বিষয়টাকে স্বচ্ছ করে তোলা নিয়ে একটি আলোচনা। দুদিনে এরকম আরও কিছু আলোচনা ছিল। গতানুগতিক আলোচনার মধ্যেও কিছু কিছু কথা উঠে এসেছে, যেগুলো ভাববার মতো। যেমন, নিখিল দে বলেন, বিনা পয়সায় নির্বাচন লড়া যায় না। আম আদমি পার্টি তাদের ওয়েবসাইটে দিল্লির নির্বাচনে কে কত টাকা দিয়েছে, তার তালিকা প্রকাশ করেছে; অথচ খরচটা প্রকাশ করেনি। নির্বাচন কর্পোরেটদের একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তাদের কাছে এটা একটা বিনিয়োগ, নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর পিছনে তারা যে খরচা করে, সেটা তারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে উশুল করে নেয়।
ব্যবসা এবং রাজনীতির যোগাযোগ থেকেই দুর্নীতির শুরু হচ্ছে … সাধারণ মানুষকে চেঁচামেচি করতে হবে
পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা বলেন, নির্বাচনে টাকার ক্ষমতার বিষয়টা খুব সহজ। আমাদের দেশে ভ্রষ্টাচার বা দুর্নীতি কোথা থেকে শুরু হচ্ছে? ব্যবসা এবং রাজনীতির যোগাযোগ থেকেই এটা শুরু হচ্ছে। ওখান থেকেই সবকিছু শুরু হচ্ছে, ওখান থেকেই কালো টাকার শুরু। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অ্যাকাউন্ট কারা অডিট করে? পলিটিকাল পার্টির নিজস্ব অডিটর এই দুর্নীতি থেকে মুক্ত নয়। পাবলিক প্রেশার অর্থাৎ আপনারা যদি সবাই মিলে এর প্রতিবাদ করেন, তাহলে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বা ক্যাগ মনোনীত অডিটরদের ভিতর থেকে কাউকে দিয়ে এই অডিট হতে পারে। পলিটিকাল পার্টি স্বাধীনভাবে তাকে বেছে নিতে পারে। এটা আমার প্রথম পয়েন্ট।
দ্বিতীয় হল, স্টার ক্যাম্পেন। একজন বলেছেন যে ৭০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত একজন প্রার্থী তাঁর ক্যাম্পেনের জন্য খরচ করতে পারে। আসলে খরচ এর চেয়েও বেশি হয়। পলিটিকাল পার্টির ক্যাম্পেনের খরচের ওপর কোনো বাধা নেই, যত খুশি খরচ তারা করতে পারে। এটা আমাদের আইনের একটা দুর্বল দিক। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। পলিটিকাল পার্টির ক্যাম্পেনের খরচের একটা সীমা অবশ্যই থাকা উচিত। এব্যাপারে আরও বেশি স্বচ্ছতা থাকা দরকার। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি ৮০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। সাধারণ মানুষকে এ নিয়ে চেঁচামেচি করতে হবে, নাহলে সরকার কিছুই করবে না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বড়ো বড়ো নেতারাও এ নিয়ে কিছু করবে না।
আর একটা ব্যাপার, এই যে ডোনেশনের ব্যাপারে ২০,০০০ টাকার সীমা, এটাও হাস্যকর। আমার কাছে অনেক কালো টাকা আছে, আমি একটা রাজনৈতিক দলকে অথবা প্রার্থীকে যতবার খুশি ১৯,৯৯৯ টাকা করে দিয়ে যেতে পারি। কোনো লোক আমাকে এ নিয়ে কিছু বলতে পারবে না। আমি ছদ্মনামেও দিতে পারি। ফান্ডিংয়ের এই সিস্টেমটা বদলাতে হবে। গোটা রাজনৈতিক শ্রেণীর ভিতরে একটা ষড়যন্ত্র আছে। রাজনৈতিক দলগুলো কেউ চায় না এটার বদল হোক। আপনারা সাধারণ মানুষ যদি উঠে না দাঁড়ান, চেঁচামেচি না করেন, এই অবস্থা এইভাবেই চলবে।
কেরালাতে ভোটাররা বহুত সেয়ানা, পয়সা দিয়ে ভোট কেনা মুশকিল
পি কে দাস বলেন, মহাত্মা গান্ধীর শিষ্য ভাই বৈকুণ্ঠ মেহতা ১৯৩৫ সালে নির্বাচনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। গান্ধী তাঁকে বলেছিলেন, দাঁড়াতে পার এক শর্তে, ভোটের জন্য কোনো পয়সা খরচ করতে পারবে না। বৈকুণ্ঠ মেহতা ভোটে দাঁড়িয়ে তাঁর আবেদন হিসেবে একটা করে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন প্রত্যেক ভোটারের কাছে। আজ নির্বাচনে অর্থদান সমস্ত প্রার্থীর জন্য সম সুযোগের অধিকারকে খর্ব করছে। নির্বাচনে দলগুলো যে টাকা পায়, তার মাত্র ৯% প্রকাশ করা হয়। এই মানি পাওয়ার আজ সারা পৃথিবী জুড়ে একটা সমস্যা। তামিলনাড়ুতে পয়সা দিয়ে ভোট কেনার ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি। কেরালাতে এটা সবচেয়ে কম। কারণ সেখানে ভোটাররা বহুত সেয়ানা!
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে দলগুলোর হিসেব-নিকেশের তথ্য মিথ্যা
সভায় ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দলগুলোর হিসেব-নিকেশ ইত্যাদির রিপোর্ট সম্বলিত একটা বই প্রকাশ করা হয়েছে। শৈলেশ গান্ধী বলেন, এই বইয়ের তথ্য মিথ্যা। ওগুলো পাবলিককে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। যতক্ষণ না সৎ রাজনীতিকে আমি আসতে দেব, এই বিষচক্র চলতেই থাকবে। অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) সুপ্রিম কোর্ট থেকে একটা জবরদস্ত রায় পেয়েছে, দলগুলোকে তার সম্পত্তির হিসেব (এফিডেভিট) দিতে হবে — এতেও কিছুই হবে না।
গণতন্ত্র তো সবচেয়ে বেশি টাকাসুরদের
এই সভার সভাপতি ত্রিলোচন শাস্ত্রী একটা গল্প বলেন, মহাভারতে বকাসুর নামে বকরূপী এক রাক্ষস একটা মানুষকে একবারেই খেয়ে ফেলত। ভীম সেই বকাসুরকে হত্যা করেছিলেন। আজ টাকাসুর সরকারকে খেয়ে নিয়েছে। এরপর তিনি আরেকটা গল্প বলেন। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় তিনি একটা গ্রামে গিয়ে দেখেন সেখানে মদ খাইয়ে ভোট কেনা হচ্ছে। একজন মদ্যপকে পেয়ে তিনি প্রশ্ন করেন, তুমি এত মদ খাও কেন? মদ্যপ ব্যক্তি বলেন, আমি তো মদ পেলে খাবই। আপনি মদের দোকানটা বন্ধ করুন।
ত্রিলোচন শাস্ত্রী সহজভাবে বুঝিয়ে বলেন, আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে। যারা নির্বাচনে বেশি পয়সা খরচ করছে, তাদের ভোট দেবেন না।
সম্মেলনের গোড়ার দিকে উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, ডেমোক্রেসি ফর দ্য পিপ্ল, বাই দ্য পিপ্ল, অফ দ্য পিপ্ল। সুভাষ চন্দ্র আগরওয়াল সেই বাণীকে ব্যঙ্গ করে বলেন, ডেমোক্রেসি বাই দ্য পলিটিশিয়ান্স, ফর দ্য পলিটিশিয়ান্স, অফ দ্য পলিটিশিয়ান্স। কিন্তু সভার শ্রোতাদের মধ্য থেকে মৃদু মন্তব্য হয়, এই কথাটাও ভুল। আসলে ডেমোক্রেসি ফর দ্য কর্পোরেট্স, বাই দ্য কর্পোরেট্স, অফ দ্য কর্পোরেট্স। গণতন্ত্র তো সবচেয়ে বেশি কর্পোরেটদের, টাকাসুরদের।
Leave a Reply