সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, কলকাতা, ৮ নভেম্বর, তথ্যসূত্র এনএপিএম-এর বিভিন্ন প্রেস বিজ্ঞপ্তি, http://www.sangharshsamvad.org/ #
গত একমাস ধরে মধ্যপ্রদেশে ছিন্দওয়াড়া জেলায় আদানি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে কৃষক ও গ্রামবাসীদের আন্দোলনের ওপর ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে মধ্যপ্রদেশ সরকার, প্রশাসন, এবং বিচারব্যাবস্থা — সম্মিলিতভাবে।
আদানি পাওয়ার, একটি কর্পোরেট বিদ্যুৎ কোম্পানি ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মধ্যপ্রদেশের ছিন্দওয়াড়া জেলায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বেসরকারি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার বরাত পায়, যার থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের ১০ শতাংশ পাবে মধ্যপ্রদেশ সরকার, ৪০ শতাংশ মধ্যপ্রদেশ সরকার কিনবে এবং বাকি ৫০ শতাংশ তারা বাজারে বিক্রি করবে। এর জন্য মধ্যপ্রদেশ সরকার তাদের ৩০০ একর জমি দেয় এবং কোম্পানিটির জন্য কয়লা এবং জলের বন্দোবস্ত করবে বলে। উল্লেখ্য, আদানি পাওয়ারের গুজরাটে দুটি, মহারাষ্ট্র এবং রাজস্থানে একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে।
মধ্যপ্রদেশ সরকার ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য পেঞ্চ ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে জলের বন্দোবস্ত করার তোড়জোড় করলেও কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এ বিষয়ে প্রাথমিক আপত্তি তোলে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে। একইসাথে ছিওয়াড়ার জেলার চৌসরা এবং আশেপাশের গ্রামগুলিতে প্রকল্পের বিরুদ্ধে ও চৌরাই ব্লকের কাছে মাচাগোরা গ্রামে পেঞ্চ নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে জল টেনে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে গ্রামবাসীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছিল কিসান সংঘর্ষ সমিতি। ২০১১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে দিল্লীতে ধর্নায় বসে অধিগ্রহণের ফলে জমি হারানো চাষিরা এবং বাঁধ তৈরি হওয়ার ফলে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকা গ্রামবাসীরা। পেঞ্চ নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে প্রায় ৩১টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ৬টি গ্রাম (থাওরি টেকা, হিওয়ারখেদি, ব্রাহ্মণওয়াড়া, ভুলা, চৌসরা প্রভৃতি) পুরোপুরি ডুবে যাবে।
মধ্যপ্রদেশ সরকার ১৯৮৬ সালে পাঁচটি গ্রাম (চৌসরা, হিওয়ারখেদি, ধানোরা, টেকাথাওয়াদি, দাগাবানি পিপারিয়া) থেকে ৭৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল, চাষিদের দেওয়া হয়েছিল একর প্রতি ১৫০০ থেকে ১০,০০০ টাকা। কিন্তু মধ্যপ্রদেশ সরকার পঁচিশ বছরেও তা করে উঠতে পারেনি। এখন সেই জমিই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে আদানিকে। কিন্তু সরকার যেহেতু জমি হস্তগত করেনি, তাই চাষিরাও ওই জমির দখল ছাড়েনি, চাষ করা ছাড়েনি। ২০১০ সালে ওই জমিই সরকার আদানিকে বেচে দেয় ১৩.৫০ লক্ষ টাকা একর দামে। যদিও আদানির দাবি ছিল, তারা ক্ষতিপূরণ বাবদ একর প্রতি এক লক্ষ টাকা করে পাঁচটি গ্রামের ১৩০টি পরিবারকে দিয়েছে। কিন্তু ওই প্রকল্পের আশেপাশে যাদের জমি, তারা আশঙ্কা করছে, ওই তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের ছাইয়ে (ফ্লাই অ্যাশ) আশেপাশের জমিগুলি চাষযোগ্য থাকবেনা। তাই আশেপাশের মানুষের কাছ থেকেও বাধা আসছে।
পরিবেশকর্মী হিমাংশু ঠক্কর একটি রিপোর্টে দেখান, প্রকল্পের পরিবেশের ওপর প্রভাব (EIA) সমীক্ষা করতে কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রক থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘গ্রীন সি’ সংস্থা তাদের করা রিপোর্টে কয়লা কোন পথে প্রকল্পে আনা হবে, প্রকল্পের প্রয়োজনে জল কোথা থেকে আসবে, পেঞ্চ ব্যাঘ্র প্রকল্পে এর প্রভাব, পেঞ্চ ড্যাম এবং তোতলাদহ ড্যামের প্রভাব — এসব কিছুই রাখেনি। তাই এই পরিবেশ সমীক্ষা রিপোর্ট অসম্পূর্ণ এবং ভুল।
২০১১ সালের জুন মাসে আদানি প্রকল্পের ভাড়া করা গুণ্ডারা ভয় দেখাতে শুরু করে কিসান সংঘর্ষ সমিতির নেতা এবং প্রাক্তন সমাজবাদী পার্টির এমএলএ ড. সুনীলম এবং মহিলা কিসান সংঘর্ষ সমিতির নেত্রী অ্যাডভোকেট আরাধনা ভার্গভ-কে।
২০১২ সালের অক্টোবর মাসের ১৯ তারিখে মধ্যপ্রদেশের মুলতাই সেসন কোর্ট ১৯৯৮ সালে কৃষক আন্দোলনে পুলিশের গুলিচালনার একটি ঘটনার মামলায় মুলতাই-এর তৎকালীন বিধায়ক ড. সুনীলমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ১৯৯৭ সালে মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণভাগের বেতুল এবং আশেপাশের জেলাগুলিতে শীতকালীন বৃষ্টি এবং পোকার প্রভাবে ফসল নষ্ট হয়। সেই নষ্ট হওয়া ফসলের ক্ষতিপূরণের দাবিতে কৃষক বিক্ষোভ হতে থাকে। ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি বেতুল-এ প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক মিছিল করে। বেতুল-এর জেলাশাসক তখন একর প্রতি ৪০০ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা করেন, ক্ষতির তুলনায় তা কিছুই নয়। ১১ জানুয়ারি বিক্ষোভরত কৃষকরা মুলতাই তহশীল এবং আরও সাড়ে চারশো গ্রাম দখলের ডাক দেয়। এই ঐতিহাসিক দখল ধর্মঘটে কিছু বাস পোড়ে। ১২ জানুয়ারি কৃষকরা তাদের নেতা ড. সুনীলমের নেতৃত্বে মুলতাই তহশীল অফিস দখলের কর্মসূচী নেয়। কিন্তু সুনীলম সেখানে গিয়ে পৌঁছবার আগেই বিক্ষোভরত কৃষকদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। পুলিশের গুলিতে ২৪ জন কৃষক মারা যায় এবং ১৫০ জন আহত হয়।
জানা যায়, এই কৃষক গণহত্যার আদেশ এসেছিল স্বয়ং তৎকালীন কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিং-এর কাছ থেকে। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়, পুলিশি হেফাজতে মারাতমকভাবে পেটানো হয় তাকে এবং তিনমাস পরে সমাজকর্মীদের হস্তক্ষেপে তিনি ছাড়া পান। প্রখ্যাত সমাজকর্মী প্রয়াত সুরেন্দ্র মোহন মুলতাই-এ গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন। মধ্যপ্রদেশ সরকার সুনীলম সহ আরও ২৫০ জন কৃষকের বিরুদ্ধে ৬৬টি মামলা দায়ের করে। এই কৃষক গণহত্যাকে স্মরণ করে প্রতি বছর ১৪ জানুয়ারি শহীদ দিবস পালিত হয়। সেই মামলার রায়ে এতদিন পরে মুলতাই সেসন কোর্ট সুনীলম, শেষরাও সুর্যবংশী পরমণ্ডল, এবং প্রহ্লাদ অগ্রওয়াল-কে সরকারি কর্মীদের হত্যার চেষ্টার ইত্যাদি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু কোনও পুলিশ, কোনও সরকারি অফিসার, কোনও মন্ত্রীর কৃষক গণহত্যার দায়ে কোনও সাজা হয়নি। জেল থেকে সুনীলম চিঠি লিখে জানান, তারা এই রায়ই আশা করেছিলেন। আদানি তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ এবং পেঞ্চ ড্যামের বিরুদ্ধে জন আন্দোলন আটকাতেই অন্য একটি মামলায় এই রায় দেওয়া হল। এই রায় বিচারব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করছে।
অক্টোবরে সুনিলম-কে জেলে পোরার পর নভেম্বরের ৩ তারিখে আন্দোলনের আরেক নেত্রী আরাধনা ভার্গভ-এর বাড়ি ঘেরাও করে তাকে গ্রেফতার করে মধ্যপ্রদেশ পুলিশ। তাকে জেল কাস্টডিতে পাঠানো হয়। ৪ নভেম্বর সকালবেলা সমাজকর্মী মেধা পাটকর ছিন্দওয়াড়া পৌঁছলে পুলিশ বাহিনী তাকে আটকায়। তাকে বলা হয়, ৩০ অক্টোবর থেকে ছিন্দওয়াড়া, অমরওয়াড়া এবং চৌরিতে ১৪৪ ধারা চলছে। মেধা এই আদেশের কপি চাইলে তাকে তা দেওয়া হয়নি। এই কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, কারণ ৩ নভেম্বর সেখানে তেন্দু পাতার বোনাস নিয়ে পাবলিক মিটিং করে গেছেন বর্তমান বিজেপি সরকারের বনমন্ত্রী সরতাজ সিং, বিজেপি-র কৃষক মোর্চা চৌরাই-তে মিটিং করেছে, দিন দয়াল অন্ত্যোদয় মেলা করা হয়েছে তামিয়াতে। আদেশ না মেনে অনশন সত্যাগ্রহ শুরু করলে মেধা পাটকর, ব্রজকিশোর চৌরাশিয়া, এবং রাজকিশোর সহ কিসান সংঘর্ষ সমিতির আরও ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ৭ নভেম্বর তারা জামিন পায়।
এই আদানি কর্পোরেট ২০০৮-২০০৯ সালে কংগ্রেস দলকে চাঁদা দিয়েছিল আড়াই কোটি টাকা, ২০০৪-০৫ সালে বিজেপিকে চাঁদা দিয়েছিল তিন কোটি সাড়ে বিরাশি লক্ষ টাকা, ২০০৭ থেকে ২০০৯ এর মধ্যে ফের বিজেপি-কে দিয়েছিল এক কোটি পঁচিশ লক্ষ টাকা (তথ্যসূত্র : ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচ)।
Leave a Reply