পাঠক — অমিতাভ চক্রবর্ত্তী, কোচবিহার#
রবীন মজুমদারের লেখা ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র স্মরণ বিস্মরণ ও নির্মাণ’ এই নাতিদীর্ঘ বইটি ২০১০ সাল থেকে শুরু করে তার পরবর্তী দুই বছর বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রফুল্লচন্দ্র বিষয়ক আটটি প্রবন্ধের সংকলন। বইয়ের শুরুতেই লেখক নিজের কৈফিয়তে লিখেছেন ‘এই বই প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনী নয়; স্তুতি নয়, নিন্দাও নয়। বলা যেতে পারে এই হল একটি অনুসন্ধানী পথরেখা। অনুভবের যাত্রাপথ। …’
আটটি প্রবন্ধের এই সংকলনের লেখক রবীন মজুমদারের কর্মস্থল বিজ্ঞান কলেজ। একদা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়েরও কর্মস্থল ছিল তা এবং পরিণত বয়েসে সেই কলেজের একটি ঘরেই তিনি জীবনের শেষদিন অবধি বসবাস করতেন। প্রফুল্লচন্দ্রের অস্তিত্বের এত কাছাকাছি থেকেও লেখক সচেতনভাবে চেষ্টা করেছেন যাতে ব্যক্তি প্রফুল্লচন্দ্রকে খোঁজার চেষ্টায় তাঁর মহান কীর্তি দ্বারা তিনি আচ্ছন্ন হয়ে না পড়েন।
বইয়ের প্রথম প্রবন্ধ ‘সার্ধশতবর্ষে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র : তাঁর মতো বিজ্ঞানীর দিন কি শেষ?’ এই প্রবন্ধে অধ্যাপক দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মারকিউরাস নাইট্রাইট বস্তুটারই অস্তিত্ব নেই’ — বক্তব্যের যথাযথ সমালোচনা করেছেন। একথা সত্যি যে ইউরোপ বা আমেরিকার স্বীকৃতি ছাড়া আজও কোনো বৈজ্ঞানিক বিষয় বিশ্ব-দরবারে প্রতিষ্ঠা পায় না। আর আমরাও বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীকে ইউরোপ বা আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই বিচার করে থাকি। পশ্চিমবিশ্বে মহান বিজ্ঞানীর স্বীকৃতি না পাওয়া প্রফুল্লচন্দ্রের আবিষ্কার তথা বিজ্ঞান ভাবনাকে আক্রমণ করে অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রসায়নবিদও বলেন ‘গল্পগাথায় রায়ের যে কীর্তির চেয়ে মহৎ প্রতিভাধর ছবি গড়ে উঠেছে, তিনি মোটেই তেমন ছিলেন না’। প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনের একাধিক ঘটনা, তাঁর জীবনদর্শন এবং কর্মোদ্যোগের উদাহরণ দিয়ে লেখক অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যের জোরালো বিরোধিতা করেছেন।
দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘এক বিস্তৃত ও পরিত্যক্ত দিশারী’ শীর্ষক আলোচনায় আমরা প্রধানত বিপুল কর্মক্ষমতাসম্পন্ন এক উদ্যমী প্রফুল্লচন্দ্রকে পাই। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী এবং শিল্প ও বিজ্ঞানশিক্ষা বিষয়ক তথ্যবহুল অনুচ্ছেদগুলি একদিকে যেমন সুখপাঠ্য তেমই পাঠককেও নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করায়। বেঙ্গল কেমিক্যালসের উৎপত্তি ও কলেবর বৃদ্ধির সাথে সাথে এই তথ্যও পাঠকবর্গ অবগত হন যে কোম্পানির পরিচালকমণ্ডলীর সাথে লভ্যাংশ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে মতবিরোধ হওয়ায় আদর্শবান প্রফুল্লচন্দ্র ১৯৪০ সালে কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। প্রবন্ধের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে প্রফুল্লচন্দ্রের প্রশংসা ও কাজকর্মের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করলেও, একথা বলতেও লেখক পিছপা হননি যে ‘বিজ্ঞানী হিসেবে ল্যাবরেটরির কাজকর্মের ধারা বজায় রেখে দেশসেবা চালিয়ে যেতে এবং লন্ডন কেমিক্যাল সোসাইটির সভাপতির অনুরোধ ঠেলতে না পেরে তিনি একরকম সমঝোতাই করেছিলেন বলে মনে হয়’। এই প্রবন্ধের ‘স্থিতিশীল উন্নয়ন’ বিষয়ক অনুচ্ছেদগুলিও পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে যুগোপযোগী বলেমনে করা হয়।
তৃতীয় প্রবন্ধে ‘প্রফুল্লচন্দ্র ও পরিবেশ’ বইয়ের আটটি প্রবন্ধের মধ্যে কলেবরে সংক্ষিপ্ততম। এই প্রবন্ধ এবং এর পরবর্ত্তী ‘সবুজ অ স্থিতিশীল রসায়ন শিল্পের অগ্রদূত’ প্রবন্ধের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে প্রফুল্লচন্দ্র রচিত ‘আত্মচরিত’-এর অংশ উপস্থাপন করে এবং বেঙ্গল কেমিক্যাল তথা বিজ্ঞানীর জীবনের বিভিন্ন সময়ের ঘটনার উল্লেখ করে পরিবেশ ও স্থিতিশীল উন্নয়নে তাঁর প্রাসঙ্গিকতার দিকটিই লেখক আরেকবার তুলে ধরেছেন। পুঁথিসর্বস্ব বিজ্ঞানশিক্ষা এবং এর প্রয়োগের মধ্যে যে আসমান-জমিন ফারাক আমাদের দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় দেখা যায়, সে প্রসঙ্গেও প্রফুল্লচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গী এই প্রবন্ধে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে।
বইয়ের পঞ্চম প্রবন্ধ ‘প্রফুল্লচন্দ্র কি বিজ্ঞানমনষ্ক ছিলেন?’ আসলে প্রফুল্লচন্দ্র বিষয়ক লেখকের ভাষণাশ্রয়ী রচনা। এর প্রথমভাগে ‘বিজ্ঞানমনষ্কতা’ আসলে কী, সে বিষয়ে লেখক নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন।
তবে এই প্রবন্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বোধহয় ‘দালাল প্রফুল্লচন্দ্র’ শীর্ষক অনুচ্ছেদগুলি যেখানে নকশাল নেতা সরোজ দত্তের লেখার খন্ডাংশ পাঠকের সামনে উপস্থিৎ হয়। সরোজ দত্ত একদা প্রফুলচন্দ্রকে পুঁজিপতিদের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। আর তার পরিপ্রেক্ষিতে লেখক খানিকটা আবেগের সাথে অথচ যুক্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে এই নকশাল নেতার বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন।
ষষ্ঠ প্রবন্ধ ‘প্রফুল্লচন্দ্রের বিজ্ঞানবোধ’ লেখাটিতে আধুনিক বিজ্ঞানে ইউরোপের তুলনায় ভারতের পিছিয়ে পড়ার কারন হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্রের মতামত ব্যক্ত হয়েছে। এই ভারতীয় বিজ্ঞানী যেখানে ভারতীয়দের ‘করণকৌশলের জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক মানসিকতার অবক্ষয়’-এর কারণ হিসেবে ভারতীয় জীবনদর্শনে শঙ্করাচার্য্যের মায়াবাদের অনুপ্রবেশকে এবং হাত ও মগজের সমন্বয়ের অভাবকে দায়ী করেছেন। প্রবন্ধটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘অলঙ্কার প্রস্তুতিতে সোনার অপচয়’ সম্বন্ধে প্রফুল্লচন্দ্রের মূল লেখার (এ হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি, ভল্যুম ১) বঙ্গানুবাদের মুখ্য অংশ। তবে আচার্য্য রায় রচিত মুল বইটির পরবর্ত্তী সংস্করণগুলি তাঁরই ছাত্র প্রিয়দারঞ্জন রায়ের সম্পাদনায় যে কি করে এতটা পরিমার্জিত বা বলা ভালো পরিবর্তিত হয়ে গেল, যা রায়-এর মূল ভাবনার সঠিক প্রকাশের পথেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালো, তা এই প্রবন্ধে লেখক বিচক্ষণতার সাথে বিশ্লেষন করেছেন।
সপ্তম প্রবন্ধটি তাঁর লেখা পূর্ববর্ত্তী প্রবন্ধগুলির অনুকরনে এবং বিজ্ঞান ও অগ্রগতির সম্বন্ধীয় বর্তমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিপ্রেক্ষিতে লেখা। এখানেও লেখক স্পষ্টভাষায় প্রফুল্লচন্দ্রের স্থিতিশীল উন্নয়ন ভাবনা এবং তাঁর নামের অপব্যাবহারে নয়াচরে প্রস্তাবিত ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় পেট্রোক্যেমিক্যালস প্রাইভেট লিমিটেড’ এর পেছনে সরকারি মনোভাবের সমালোচনা করেছেন।
বইয়ের শেষ প্রবন্ধে লেখক বিখ্যাত রসায়নবিদ অনিমেষ চক্রবর্ত্তীকে উদ্ধৃত করে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আবিষ্কৃত মারকিউরাস নাইট্রেট যৌগের অস্তিত্ব সম্পর্কে পাঠকবর্গকে নিঃসন্দেহ করেন, প্রথম প্রবন্ধের সূত্র ধরেই। তবে বইয়ের অনেক জায়গাতেই এই একটি ঘটনার পুনরুক্তি ঘটেছে যা প্রথমেই লেখক স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু সবমিলিয়ে একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের এই সঙ্কলন প্রকৃতপক্ষেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সম্পর্কে লেখকের এক ‘অনুভবের যাত্রাপথ’।
Leave a Reply